হাওড়া ব্রিজের নতুন আলোকসজ্জা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
এনআরসি বিতর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কলকাতা সফর ঘিরে শনিবার সারাদিন ধরে মুহূর্তে মুহূর্তেই আছড়ে পড়েছে ক্ষোভের ঢেউ। কিন্তু তার মধ্যেই এ দিন হাওড়া ব্রিজের যে আলোর উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী, সেই আলোয় শহরের দুর্গাপুজো-ইদ এক সূত্রে বাঁধা পড়বে বলে জানাচ্ছেন বন্দরের কর্তাদের অনেকেই।
দেড় বছর আগে এই নতুন আলো লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তখন থেকেই মাথায় রাখা হয়েছিল, যেন সেই আলো শহরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে যায়। বিশেষ করে শহরে উৎসবের মুহূর্তে সে দুর্গাপুজো, ক্রিসমাস বা ইদ-ই হোক, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আলো-আবহ পরিবর্তন করা যায়। এক বন্দরকর্তার কথায়, ‘‘একাধিক থিমের আলো তৈরি করা হয়েছে। সেগুলি সাধারণ দিনে তো জ্বালানো হবেই। তবে উৎসবের দিনগুলিতে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোর পরিবর্তন ঘটানো হবে।’’ কলকাতা গবেষক হরিপদ ভৌমিক বলছেন, ‘‘যেখানে এত বিভাজনের কথা অহরহ শোনা যাচ্ছে, সেখানে দুর্গাপুজো-ইদের সংস্কৃতি এ ভাবে ফুটে ওঠাকে স্বাগত।’’
বন্দর সূত্রের খবর, এমনিতে ২০০৬ সালে প্রথম বারের জন্য চিরাচরিত আলোর পথ ছেড়ে সোডিয়াম ভেপার আলোয় উত্তরণ হয়েছিল হাওড়া ব্রিজের। পাল্টে গিয়েছিল রাতের কলকাতা। গত ১৪ বছর ধরে সেই আলোই দেখে আসছেন শহরবাসী। হাওড়া ব্রিজের নতুন এই আলোকসজ্জার আগে রীতিমতো গবেষণায় বসেছিলেন বন্দরের কর্তারা। কী ভাবে আলোর পর্বান্তর করা হবে, তা জানানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরকে। কারণ, তারাই এই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-কে বাস্তবায়িত করেছে। মূল লেখার আগে যেমন তার অনেক খসড়া থাকে, ঠিক তেমন ভাবেই হাওড়া ব্রিজের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরি করেছিল পূর্ত দফতর। তার মধ্যে থেকেই বর্তমান আলোকসজ্জাটি চূড়ান্ত হয় বলে বন্দর সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন: ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই আটকে যাত্রীরা
যেখানে পুরনো সোডিয়াম ভেপার আলোক ব্যবস্থা পাল্টে ফেলা হয়েছে এলইডি আলোয়। গবেষণা করা হয়েছিল বিদেশের সেতুগুলি নিয়েও। বন্দরের হেরিটেজ কো-অর্ডিনেটর গৌতম চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গত বছরের ১৭ জুলাই লন্ডনের টেমস নদীর উপরে ঐতিহ্যশালী লন্ডন ব্রিজকে এলইডি আলোয় সাজানো হয়েছিল। একই সঙ্গে লন্ডনের আরও তিনটি ব্রিজ ক্যানন স্ট্রিট, মিলেনিয়াম এবং সাউথওয়ার্কও সেজে ওঠে নতুন আলোয়। হাওড়া ব্রিজের মতো ক্যান্টিলিভার ব্রিজের সঙ্গে তুলনীয়, যেমন কানাডার মন্ট্রিয়লের জ্যাক কার্টিয়ার ব্রিজ অথবা আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর বে-ব্রিজও এই ধরনের আলোকসজ্জায় সজ্জিত। সেগুলি সবই মাথায় রাখা হয়েছিল।’’
ইতিহাস বলছে, বরাবরের বিস্ময় হাওড়া ব্রিজের উদ্বোধনের সময়টাই ছিল রোমহর্ষক! ১৯৪৩-এর ৩ ফেব্রুয়ারি যখন ব্রিজটি উদ্বোধন করা হয়েছিল তখন মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ হচ্ছে কলকাতা বন্দরে! সেই অবস্থায় চার দিক অন্ধকার করে ব্রিজ চালু করা হয়েছিল। বন্দর সূত্রের খবর, বর্তমানে রোজ দেড় লক্ষেরও বেশি যানবাহন ও আড়াই লক্ষের বেশি মানুষ বিশ্বের ব্যস্ততম এই ক্যান্টিলিভার ব্রিজ দিয়ে যাতায়াত করেন। হাওড়া ব্রিজে রং করার তথ্যটিও চমকে দেওয়ার মতো! ২০১৪ সালে পুরো ব্রিজ রং করতে প্রায় ২৬ হাজার লিটার সিসামুক্ত রং লেগেছিল আর সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে সাত মাস!
এ বার আলোয় পর্বান্তরের পালা। যে পর্বান্তরে মিলেমিশে যাবে দুর্গাপুজো-ইদের আবহমান সংস্কৃতি!