এখানে বেঁচে থাকে সবার শহর

এই কলুটোলা স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থলে গুজরাতের কচ্ছের মেমন সম্প্রদায় একটি মসজিদ তৈরি শুরু করে ১৯২৬ সালে। তা শেষ হয় ১৯৩৪ সালে। যা আজকের নাখোদা মসজিদ।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৯ ০৩:১৪
Share:

ঐতিহ্য: দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে পূর্ণচন্দ্র ধরের বাড়ি। (ডানদিকে) সেই মুসাফিরখানা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সে অঞ্চলে কলুরা বলদকে দিয়ে ঘানিতে তেল বানাত। প্রায় আড়াইশো বছর আগে শহর কলকাতার বুকে তেলের ঘানির ব্যবসা চলত রমরমিয়ে। যে কারণে অসংখ্য গোয়ালখানা ছিল ওই তল্লাটে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি হল ওয়েলের নির্দেশে শহরে পেশাভিত্তিক যে সব অঞ্চল গড়ে ওঠে, কলুটোলা তারই অন্যতম। কলুটোলা, অর্থাৎ কলুদের ‘টোলা’ বা পাড়া।

Advertisement

এই কলুটোলা স্ট্রিট এবং রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থলে গুজরাতের কচ্ছের মেমন সম্প্রদায় একটি মসজিদ তৈরি শুরু করে ১৯২৬ সালে। তা শেষ হয় ১৯৩৪ সালে। যা আজকের নাখোদা মসজিদ। এই এলাকা ও তার আশপাশের পরতে পরতে জড়িয়ে পুরনো কলকাতার অজানা কাহিনি। কিছু গড়িয়েছে কালের স্রোতে, কিছু আজও মাথা উঁচু করে আছে বৃদ্ধ জমিদারের মেজাজে। ধর্ম নিয়ে কচকচানি যে তুচ্ছ, তা-ই যেন শিখিয়ে দেয় এই অঞ্চলের অগোছালো জীবনযাত্রা।

সদ্য শেষ হয়েছে খুশির ইদ। রকমারি পাঁউরুটি, লাচ্ছা, সেমাই, শুকনো ফল, লোভনীয় তন্দুরি, কাবাব, হালিমের পাশাপাশি পোশাক, টুপি এবং চুড়ির অস্থায়ী দোকানগুলি নিয়ম করে ঝাঁপ নামিয়ে ফেলেছে। তবে এলাকার প্রাচীন স্থাপত্য ফৌজদারি বালাখানার নীচে এবং আশপাশে বছরের পর বছর যেমন থাকে, তেমনই রয়ে গিয়েছে লুঙ্গি, শেরওয়ানি, বোরখা, টুপি, সুরমা-সুগন্ধি, পিতলের জিনিসের সাম্রাজ্য।

Advertisement

এক উৎসবের রেশ কাটতেই ধরা পড়ে আসন্ন আরও এক উৎসবের প্রস্তুতি। এই তল্লাটের বেশ কয়েকটি বনেদি বাড়ি বংশানুক্রমে দুর্গাপুজো করে থাকে। রথের দিন থেকে তারই প্রস্তুতি জানিয়ে দিয়ে যায় বোধন এল বুঝি। কলুটোলার মতিলাল শীলের বাড়ি, দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটের পূর্ণচন্দ্র ধরের বাড়ি, গোপাল চন্দ্র লেনের বদন চাঁদ রায়ের বাড়িতে আজও ঐতিহ্য মেনে দুর্গাপুজো হয়। তারই নানা কাজে এগিয়ে আসেন এলাকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও।

কলুটোলা স্ট্রিটের আশপাশে তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিট, ইসমাইল মদন লেন, বলাই দত্ত স্ট্রিট, দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট বা গোপাল চন্দ্র লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে কয়েকটি পুরনো ইউনানি দাবাখানা। ঘিঞ্জি এই তল্লাটে কান ফাটানো রকমারি হর্ন আর পথচারীর ধাক্কা অনিবার্য। পথের দু’ধারের প্রাসাদোপম কিছু বাড়ি আজও বয়ে চলেছে প্যালাডিয়ান উইন্ডো আর জুলিয়েট ব্যালকনির পশ্চিমী স্থাপত্য। তবে বেশির ভাগ বাড়িই মলিন চেহারায়। হাতে গোনা কয়েকটি ঔজ্জ্বল্য ধরে রেখেছে। সংস্কারের ফাঁদে পা দিয়ে ঐতিহ্যকে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখার সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

এক সময়ে এই তল্লাটে একটি জেল ছিল। আজকের লালবাজারের কাছেই। নাম ছিল ‘হরিণবাড়ি’ জেল। কলকাতার ইতিহাসে কথিত সেই জেলের অস্তিত্ব বহু আগেই লুপ্ত। এই অঞ্চলের দু’টি রাস্তা লোকমুখে হরিণবাড়ি নামে পরিচিত। তথ্য বলছে, ১৭৮১ সালে লালবাজার ও হরিণবাড়ি জেল দু’টি নিয়ে পরে অন্য একটি জেল তৈরি হয়েছিল। “একটি মত, হরিণবাড়ি এসেছে ‘হয়রান বাড়ি’ থেকে। সাধারণ মানুষকে জেল-আদালতের যে হয়রানি পোহাতে হয়। তা স্মরণ করেই এমন নাম। অন্য মত, এখানেই সিরাজের হরিণ শিকারের জায়গা ছিল।” বলছিলেন পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করা অমিতাভ পুরকায়স্থ।

তল্লাটের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে ১৯০৬ সালে তৈরি বলাই দত্ত স্ট্রিটের মুসাফিরখানা হাজী বখশ ইলাহি। হলুদ রঙা পুরনো ভবনটির উপরের তিনটি তলায় কম ভাড়ায় থাকেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলমানেরা। খান বাহাদুর এস্টেট পরিচালিত মুসাফিরখানায় ১৩টি ডরমিটরি ও ৩২টি ঘর রয়েছে।

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরেই মতিলাল শীল’স ফ্রি কলেজ। তার পিছনেই তৎকালীন ব্যবসায়ী এবং দানশীল মতিলালের বাড়ি। ভিড়ের মাঝে অনেকটাই আড়াল হয়েছে লোহার জাফরির নিখুঁত কাজ আর স্থাপত্য। লাল রঙা স্থাপত্যে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বদন চাঁদের উত্তর পুরুষ। দুর্গাপুজো হয় সেখানেও। গোপাল চন্দ্র লেনের এই বাড়ির বিপরীতে আরও এক দানবীর সাগর দত্তের বাড়ি‌। সংস্কারের চাপে সে বাড়ির অবশ্য ভোল বদলেছে। দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটের ধর বাড়িতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শরিকদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সে বাড়িতে আজও পুজো হয়। পরিবারের তরফে রীতা ধর জানালেন, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় লুট হয়েছিল মূল্যবান জিনিস। প্রায় চার বছর ঘরছাড়া ছিলেন সদস্যেরা। তবে ৭১-এর যুদ্ধ এবং অযোধ্যা কাণ্ডের মতো অস্থির সময়ে কিন্তু পরিবারের ভরসা ছিলেন স্থানীয় মুসলমানেরাই।

সেই ভরসা আর বিশ্বাস আজও মিশে থাকে প্রার্থনায়। মন্দিরের ঘণ্টা আর আজানের সুর পৌঁছে যায় অলি-গলিতে, খড়খড়ি আর জাফরির ফাঁকে। এখানে বেঁচে থাকে সবার শহর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement