প্রতীকী ছবি।
পূর্ব ভারতে উৎকর্ষের নিরিখে সুনাম রয়েছে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু শল্য বিভাগের। কিন্তু চিকিৎসকের অভাবে সেখানেই এখন পরিষেবা ধুঁকছে। বাড়ছে শিশু-মৃত্যুর হার!
স্বাস্থ্য পরিষেবায় এ রাজ্যের গর্বের প্রতিষ্ঠান এসএসকেএম হাসপাতাল। সেখানেও চিকিৎসকের ঘাটতির জেরে প্রভাব পড়ছে পরিষেবায়। এ রাজ্যে শিশুদের একমাত্র ‘রেফারাল’ হাসপাতাল বি সি রায়ের অবস্থাও তথৈবচ!
এই পরিস্থিতির জন্য ‘বন্ড’ ব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলির চিকিৎসকদের একাংশ। এ রাজ্যে পেডিয়াট্রিক সার্জারির (এমসিএইচ) যে দশটি আসন রয়েছে, এ বছর তাতে মাত্র এক জন ভর্তি হয়েছেন! এনআরএসে ছ’টি আসন থাকলেও কেউ ভর্তি হননি। সেখানে গত বছর এক জন ভর্তি হয়েছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দু’টি আসনেও ফাঁকাই। এসএসকেএমের দু’টি আসনের মধ্যে একটি ভর্তি হয়েছে। সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্যের বন্ড নীতির জন্যই এখানকার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন ছাত্রেরা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, নীলরতনের শিশু শল্য বিভাগে সব সময়েই গড়ে ১৩০ জন শিশু চিকিৎসাধীন থাকে। প্রতিদিন জনা দশেক শিশু ভর্তি হয়। গড়ে প্রতিদিন ১১টি অস্ত্রোপচার হয়। তার মধ্যে সদ্যোজাতদের অস্ত্রোপচার হয় চার-পাঁচটি। নিওনেটাল সার্জারিতে ১২টি শয্যা থাকলেও ২৮-৩০টি শিশু সেখানে ভর্তি থাকে। সারা রাজ্যের ‘রেফার’ হওয়া রোগীর চাপ সামলানোর ক্ষেত্রে বিভাগের অবস্থা কার্যত নিধিরাম সর্দার। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রেরাই আসল। সেখানে ছাত্রহীন বিভাগে তিন জন যে বন্ড চিকিৎসক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জনকে সম্প্রতি এসএসকেএমে পাঠানো হয়েছে!
স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘রোগীদের ঠিক মতো পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার (অস্ত্রোপচার পরবর্তী যত্ন) দেওয়া যাচ্ছে না। এক মাসের কম বয়সিদের পাশাপাশি চিকিৎসাধীন শিশু ও বালক-বালিকাদের যত্ন নিতে হলে তিন জন রোগী পিছু এক জন চিকিৎসক দরকার। সেখানে ১২০ জন রোগী পিছু দু’জন চিকিৎসক রয়েছেন। ফলে শিশু-মৃত্যুর হারও বাড়ছে।’’
আর এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘যা পরিস্থিতি, তাতে পূর্ব ভারতের সেরা শিশু শল্য বিভাগের সুনাম ধরে রাখাই মুশকিল। দু’জন বন্ড চিকিৎসক থাকলেও ঠিক ছিল। এসএসকেএমে তাঁরা চলে যাওয়ায় এখন সেই সুযোগও নেই।’’ সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, পেডিয়াট্রিক সার্জারিতে ছাত্রের অভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
এসএসকেএম এবং বি সি রায় শিশু হাসপাতালের ছবিতেই তা স্পষ্ট। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এসএসকেএমে ২০ শয্যার বিভাগে গড়ে ৪০ জন ভর্তি থাকে। তাদের পরিষেবা দিতে প্রফেসর পদমর্যাদার চিকিৎসক রয়েছেন তিন জন। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এক জন। সিনিয়র রেসিডেন্ট তিন জন। এক জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরও নেই। পঞ্চাশ শয্যার বি সি রায় শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগে মাসে গড়ে ১৬০টি অস্ত্রোপচার হয়। সেখানে এক জন করে প্রফেসর এবং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, দু’জন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থাকলেও ছাত্র নেই।
এক সরকারি চিকিৎসকের কথায়, ‘‘ছাত্র থাকবে কী করে? তিন বছরে ৩০ লক্ষ টাকা বন্ডের শর্তে কেউ রাজ্যে পড়তে আসতে চাইছেন না। ওড়িশায় বন্ড থাকলেও উৎসাহভাতা রয়েছে। রাজস্থানে বন্ড নেই।’’ আর এক সরকারি চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এ রাজ্যে বেতন কম। অন্য রাজ্যে বেতন লোভনীয়। এক সময়ে ভিন্ রাজ্যের মেধাবীরা পশ্চিমবঙ্গে পড়তে আসতেন। এমএস, এমসিএইচ করে এত কম বেতনে আরও তিন বছর কেউ কাজ করতে চাইছেন না।’’
চিকিৎসক-সঙ্কট প্রসঙ্গে এনআরএসের বিভাগীয় প্রধান কৌশিক সাহা মন্তব্য করতে চাননি। মুখে কুলুপ এঁটেছেন বি সি রায় শিশু হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান বিদ্যুৎ দেবনাথ এবং এসএসকেএমের বিভাগীয় প্রধান রুচিরেন্দ্র সরকারও।
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বন্ড প্রথার জন্য ছাত্রেরা এ রাজ্য আসছেন না, তা নয়। সারা দেশেই পেডিয়াট্রিক ও কার্ডিয়াক সার্জারিতে ছাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত খাটনির তুলনায় পুরস্কার নেই বলে অনেকে সার্জারির অন্য বিভাগে যাচ্ছেন। শিশুদের অস্ত্রোপচারে সাফল্যের হার কম। ফলে পরিজনেদের রোষ পড়ে চিকিৎসকের উপরে। এটিও একটি কারণ।’’