সেনার পোশাকে গ্রেফতার অভিযুক্ত। —নিজস্ব চিত্র
বেলা সাড়ে ১২টা, বুধবার। বাটানগরের বাড়ি থেকে নিজের লাল রঙের সেডান গাড়িতে চেপে নিউ আলিপুরের সাহাপুর কলোনির ট্রাভেল এজেন্সির অফিসের দিকে রওনা হন সংস্থার মালিক অরিন্দম ধর।
বাটানগর-জিঞ্জিরা বাজার ব্রিজে গাড়ি উঠতেই রাস্তা আটকায় একটি লাল রঙের এসইউভি। অরিন্দমের সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন দেহরক্ষীও। অরিন্দম পুলিশকে জানিয়েছেন, আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে সেনার পোশাক পরা কয়েক জন যুবক তাঁকে গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করেন। তার পরেই তাঁকে তুলে নেওয়া হয় একটি স্টিল রঙের গাড়িতে। সঙ্গের দেহরক্ষীদের একই কায়দায় তোলা হয় লাল রঙের ওই এসইউভিতে।
ভরদুপুরে নিউআলিপুরে দুষ্কৃতীদের হাত থেকে কোনও মতে রক্ষা পাওয়া অরিন্দম পুলিশকে জানিয়েছেন, অপহরণকারীরা তাঁর কাছে ২০০ কোটি টাকা মুক্তিপণ চায়। তিনি তখন অপহরণকারীদের জানান, তাঁর সাহাপুর কলোনির অফিসে টাকা রয়েছে। তাঁকে যেন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সেনার পোশাক পরা কয়েক জন অরিন্দমের হাতে হাতকড়া পরিয়ে সাহাপুর কলোনির অফিসের সামনে নামে। প্রথমে এলাকার লোকজন অপহরণকারীদের পুলিশ বলে ভেবেছিলেন। তাই তাঁরা দূরে সরে যান। কিন্তু অরিন্দম নেমেই সুযোগ বুঝে চিৎকার শুরু করে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, এর পরেই এক জন অপহরণকারী গুলি চালায়। সেই গুলি অরিন্দমের পা ছুঁয়ে যায়। কিন্তু তত ক্ষণে এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে যান। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় অপহরণকারীদের এক জন।
ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, পাকড়াও হওয়া ওই দুষ্কৃতীর নাম সঞ্জয় রায় ওরফে লেবু। সে বেহালার বাসিন্দা। তার কাছ থেকে একটি দেশি সিঙ্গল শটারও পাওয়া গিয়েছে। সঞ্জয় এবং অরিন্দমকে জেরা করে নিউ আলিপুর থানার পুলিশ ও কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডা দমন শাখা কয়েক জনের নাম জানতে পারে। গোয়েন্দা প্রধান প্রবীন ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, ‘‘অরিন্দম কয়েক জনকে চিনতে পেরেছিলেন। তার মধ্যে তাঁর এক আত্মীয়ও রয়েছেন।” সেই সূত্র ধরেই এ দিন সন্ধ্যার মধ্যেই সঞ্জয় ছাড়াও আরও চার জন— রাজা দত্ত, শম্ভু সোনি, পরিমল রাই এবং তপন সাহাকে গ্রেফতার করা হয়। জানা যায়, অরিন্দমকে নিয়ে রওনা হওয়ার পরেই তাঁর রক্ষীদের একটি নির্জন জায়গায় ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃত রাজা নিউ আলিপুর এলাকার কুখ্যাত তোলাবাজ। খুনের মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অন্য দিকে, ধৃত তপন সাহা অরিন্দমের আত্মীয়। পুলিশ বাকি অপহরণকারীদেরও চিহ্নিত করেছে। রাতের মধ্যেই তাদের পাকড়াও করা যাবে বলে আশা পুলিশের।
আরও পড়ুন: খেজুরিতে ভারতীর গাড়ি আটকাতেই বিক্ষোভ বিজেপির, মহিলা পুলিশকে হেনস্থা
আরও পডু়ন: ছেলেকে গাড়িতে আটকে দিঘায় সমুদ্র স্নানে বাবা-মা, মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনল পুলিশ
কিন্তু অপহরণের উদ্দেশ্য নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে গোয়েন্দাদের মনে। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘অরিন্দম দাবি করেছেন, তাঁর কাছে ২০০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল। ওই বিশাল অঙ্কের টাকা চাওয়াটা সন্দেহ বাড়াচ্ছে গোয়েন্দাদের।’’ তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, অরিন্দমের বিরুদ্ধেও একাধিক প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের টোপ দিয়ে তিনি বাজার থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা তুলেছেন বলে খবর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, বাজার থেকে তোলা টাকা অরিন্দম নেপালে একটি ক্যাসিনোতে লগ্নি করেছে।
গোয়েন্দাদের ধারণা, অরিন্দমের কাছে তোলা হিসেবে টাকা চেয়েছিল রাজা। তার উপর ক্যাসিনো আছে শুনে রাজা এবং বাকি অপহরণকারীদের ধারণা হয়, অরিন্দমের কাছে বড় অঙ্কের নগদ টাকা রয়েছে। সেই লোভেই অরিন্দমকে অপহরণ করে ভয় দেখিয়ে অফিস থেকে টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছিল রাজা এবং তার দলবল। তবে প্রতারণাকে কেন্দ্র করে অন্য কারও সঙ্গে শত্রুতার জেরে অপহরণের চেষ্টা কি না তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কারণ অরিন্দমের কথাতেও প্রচুর অসঙ্গতি পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তদন্তকারীরা মনে করছেন, বাকি দুষ্কৃতীরা ধরা পড়লেই পরিষ্কার হবে অপহরণের উদ্দেশ্য। গোয়েন্দা প্রধান জানিয়েছেন, অপহরণকারীরা সবাই বেহালা-নিউ আলিপুর এলাকার। তবে দিনদুপুরে শহরের রাস্তায় এ রকম বেপরোয়া অপহরণ চিন্তায় ফেলেছে পুলিশ কর্তাদের।