প্রতীকী ছবি।
স্বামী-স্ত্রীর বিবাদের মধ্যে নিজেদের শিশুকে টেনে শিখণ্ডী করবেন না। অনাবাসী দম্পতিকে এমনই ভাষায় ভর্ৎসনা করে বলল কলকাতা হাই কোর্ট। শিশুর ‘অধিকার’ নিয়ে করা এক মামলার শুনানিতে শুক্রবার বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের মন্তব্য, ‘‘স্বামী-স্ত্রীর লড়াইয়ে সন্তানকে শিখন্ডি করবেন না। আপনাদের দ্বন্দ্ব থেকে শিশুটিকে বার করে আনুন। কারণ, এই সমস্ত কিছুর ভার আগামিদিনে তাকেই বহন করতে হবে।’’ একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের নির্দেশ, আমেরিকাবাসী বাবার সঙ্গে প্রতি দিন ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলবেন ছেলে।
ঘটনার সূত্রপাত, ২০১৪ সালের জানুয়ারি। সে বছরই আমেরিকাবাসী গুগলের ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার প্রণব খৈতানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নেহা সিংহের। প্রণবের পৈত্রিক বাড়ি নিউ আলিপুরে। নেহার রৌরকেলায়। বিয়ের পর তাঁরা আমেরিকায় চলে যান। কিছু দিন পরেই শুরু হয় দাম্পত্য কলহ। তারই মধ্যে ২০১৬-র ১ ডিসেম্বর খৈতান দম্পতির পুত্র ঈশানের জন্ম হয়। জন্মসূত্রে ঈশান আমেরিকার নাগরিকত্ব পায়।
অভিযোগ, নেহা তাঁর স্বামী এবং সন্তানকে মারধর করতেন। তাঁদের উপর অত্যাচার করতেন। প্রণবের আইনজীবী রাতুল বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমেরিকার আইন অনুযায়ী সন্তানের উপর অত্যাচার হলে, অভিভাবকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রতিবেশীরা অভিযোগ করলেও, পুলিশ তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়। এ ক্ষেত্রে স্বামী এবং প্রতিবেশীদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ নেহার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে সে দেশের পুলিশ। মামলা গড়ায় আদালতে।’’
রাতুল হাই কোর্টে জানিয়েছেন, পুলিশি তদন্তের ভিত্তিতে আমেরিকার আদালতে মামলা হয়েছিল। কিন্তু সেই মামলা চলাকালীন ঈশানকে নিয়ে ভারতে চলে আসেন নেহা। ২০১৯ সালের ১৫ অগস্ট আমেরিকার আদালত, বাবার কাছে সন্তানকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর জন্য দুই রাষ্ট্রকে সাহায্য করার কথাও বলা হয় আমেরিকার আদালতের রায়ে। বলা হয়, আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে আমেরিকার গোয়েন্দা পুলিশ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা পুলিশের ডিজি এবং ভারতের আইনমন্ত্রীকে।
কিন্তু আমেরিকার আদালতের নির্দেশের পরও ঈশানকে ফেরত পাননি প্রণব। তাই তিনি কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন। তখন এ রাজ্যের পুলিশ মারফত জানা যায়, রৌরকেলায় বাপের বাড়িতে পুত্রকে নিয়ে রয়েছেন নেহা। ৬ বছরের ঈশানকে প্রণবের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে নেহার অবস্থান জানতে চায় হাই কোর্ট। শুক্রবার শুনানিতে ভার্চুয়াল মাধ্যমে নেহার সঙ্গে হাজির ছিল ঈশানও। মায়ের কোল থেকেই দুই বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেন। অন্য দিকে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশ নেন প্রণব।
নেহার উদ্দেশে বিচারপতি শিবজ্ঞানমের মন্তব্য, ‘‘শিশুটি এখন ছোট। আমরা কথা বললাম তার সঙ্গে। খুব বুদ্ধিমান ছেলে। এখন কিছু নয়। শিশুটি বড় হলে বাবার খোঁজ করলে কী উত্তর দেবেন? আপনাদের ইগোর লড়াইয়ে ওকে ভুগতে হবে। আমরা মায়ের থেকে শিশুকে আলাদা করতে চাইছি না।’’
শুনানি-পর্বে প্রণব আদালতকে জানান, ‘‘আমার সন্তান আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছে। সেখানে পড়াশুনা করেছে। আমি এখানে ভাল শিক্ষা দিতে পারব। আমার সন্তানের যথাযথ যত্ন নিতে পারব।’’ অন্য দিকে নেহা বলেন, ‘‘আমেরিকাতেই সব কিছু ভাল পাবে। এটা ঠিক নয়। আমি আর ছেলেকে নিজের মতো করে সব সময় খুশি রাখব।’’
আদালতের নির্দেশ, এ বার থেকে প্রতি দিন ছেলের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলবেন বাবা। ছোট শিশুর জন্য মাকেই সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যদিও নেহা ওই ভিডিয়ো-কথোপকথনে অংশ নিতে পারবেন না। বিকেলে খেলতে যাওয়ার আগে বা দুপুরে খেতে যাওয়ার আগে ঈশান তার বাবার সঙ্গে আধ ঘণ্টা কথা বলবে রোজ। পরবর্তী পর্যায়ে ফের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে আদালত দেখবে।