সরব: অম্বেডকরের পোস্টার হাতে মিছিলে। নিজস্ব চিত্র
অভাবের সঙ্গে লড়াই করা যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেও মাথা তোলা সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ‘নতুন নাগরিকত্ব আইন’ নামক বিভ্রান্তিকর, বিভেদ-রাজনীতির সঙ্গে যুঝবার কৌশল জানা ছিল না সুন্দরবনের অন্য প্রান্ত, হিঙ্গলগঞ্জের মানুষের! কিন্তু তাঁরা ধৈর্য না হারিয়ে শান্তির মিছিলে পা মেলালেন। ধর্ম-সঙ্কটের দুর্দিনেও সম্প্রীতির কথা শোনালেন। আস্থা থাকল মানবতায়। খুব কাছ থেকে আবারও দেখলাম, ধর্মীয় ভেদাভেদ সত্যের কাছে আজও তুচ্ছ!
সুন্দরবনের ইতিহাস বলে, দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে উৎখাত হওয়া অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষই বাদাবন পরিষ্কার করে আবাদ ভিটে গড়েছিলেন। অথচ এখানকার অসংখ্য মানুষ আবাদ জমির মালিকানা পাননি আজও। দেশভাগের পরে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, মেদিনীপুরের বন্যা বা মরিচঝাঁপির গণ হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে মানুষ ঠাঁই নিয়েছিলেন এখানে। বিল, নদী-পাড়ের সরকারি খাস জমিতে মাটির ঘর তুলে ‘জমির মালিকানাহীন চাষি’ বা ‘বর্গা-চাষি’ পরিচয়েই রয়েছেন অনেকে। তাঁদের নাগরিকত্ব, ধর্ম নিয়ে কেউ এত কাল প্রশ্ন তোলেননি। রুটি-রুজির লড়াইয়ে প্রশ্ন তোলার ফুরসতই বা কখন! বরং সম্প্রীতির সহজ চর্চাই বেঁধে রেখেছে এঁদের। বনবিবির পুজো বা গাজি পিরের বন্দনায় একে অপরের সঙ্গে যে মিলন সংস্কৃতি গড়েছেন, তা সহজে নস্যাৎ করা অসম্ভব। জনগণনার পাতায় অথবা ভোটার তালিকায় যতই ‘অনগ্রসর’ ভারতীয় হিসেবে হিঙ্গলগঞ্জবাসীর পরিচয় নথিবদ্ধ থাকুক, সম্প্রীতির অনন্য নজির ছড়িয়ে নোনামাটির সুন্দরবনে!
দেশ ‘ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন’ দেখছে। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশের’ বাজনা বাজছে রাষ্ট্রের আকাশে-বাতাসে। অথচ হিঙ্গলগঞ্জের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে সম্প্রীতি দু’হাতে আগলে রেখেছেন। এ দেশ কিন্তু ওঁদের অজানা আশঙ্কায় ঠেলে দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না।
‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, অথচ কিল মারার গোঁসাই’ হয়ে একটি নয়া আইন যেন তাঁদের প্রশ্ন করছে, ‘নাগরিকত্ব প্রমাণের কী কাগজ আছে? তুমি হিন্দু শরণার্থী, না মুসলিম অনুপ্রবেশকারী?’ বুঝতে পারছিলাম, এই ‘অভূতপূর্ব’ প্রশ্নে প্রাথমিক ভাবে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন এখানকার মানুষও। “নাগরিকত্ব প্রমাণের কী কাগজ চাই? কোথায় পাব?”―জিজ্ঞাসা করছিলেন অসহায় মানুষ। ভিড় বাড়ছিল পঞ্চায়েতে, বিডিও অফিসে।
“দলিল, পরচা, বাস্তুভিটার কাগজ আয়লার পরে ক’জনের কাছে অক্ষত আছে!” আক্ষেপ করছিলেন কিছু প্রবীণও। তামিলনাড়ু, কেরলে দিনমজুরি খাটতে যাওয়া অভিভাবকের ঘনঘন ফোন আসছিল। দিশেহারা অনেকেই অন্তত ‘স্কুল সার্টিফিকেট’ জোগাড়ে মরিয়া হয়ে পড়ছিলেন। দেখছিলাম, কী ভাবে নষ্ট হচ্ছে ওঁদের জীবনের ছন্দ। দৈনিক মজুরিতেই যাঁদের সংসার চলে, তাঁদের একটিও কাজের দিন নষ্ট করার সাংবিধানিক অধিকার কি কারও আছে?
যে দিন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হল, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অবরোধ, স্টেশনে অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুরের পরেও হিঙ্গলগঞ্জ ধৈর্য হারায়নি। সঙ্কটের দিনেও হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায় কখনওই একে অপরের থেকে হাত আলগা করেনি। এটাও সেই ভারতবর্ষ!
বছর পাঁচেক আগে স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে এসে দেখেছিলাম, মোট পড়ুয়ার দশ শতাংশেরও কম মুসলিম। আশপাশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের এক দিন স্কুলে ডেকে বলেছিলাম, “ক্লাস ফাইভে আমাদের কিছু মুসলিম পড়ুয়া পাঠান।” তাঁরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, সরকারি গ্রান্টের ব্যাপার আছে কি না। ওঁদের আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, “হিন্দু-মুসলিম ছাত্রছাত্রী যত একসঙ্গে বড় হবে, আগামীতে ততই সম্প্রীতির ভিত মজবুত হবে।” ওঁরাও সহমত হন। ফলস্বরূপ বাড়তে থাকে মুসলিম পড়ুয়া। বর্তমানে আমাদের বিদ্যালয়ে ৩০ শতাংশ মুসলিম ছাত্রছাত্রী। মাদ্রাসা থেকেও আসছে মুসলিম ছাত্র।
ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের পারস্পরিক আস্থার ভিতরে সম্প্রীতির সেতু এ ভাবেও তো মজবুত হয়? নয়া আইন নিয়ে যখন রাজ্য জুড়ে চলা ধুন্ধুমারে নবম শ্রেণির ছাত্রী মালিহা মুমতাজকে নিয়ে আটকে আছি কলকাতায়, তখন ছাত্রীর বাবা হারুন আল রশিদ নির্দ্বিধায় বলেন, “মেয়ে আপনার কাছে আছে মানে চিন্তা নেই!” এই আস্থাটুকু তৈরি হওয়া আজ সবার জন্য প্রাসঙ্গিক। সংখ্যাগুরুর সব প্রতিনিধির দায়িত্ব এই ‘আস্থা’ তৈরি করা। বহুত্ববাদের আদর্শ টিকিয়ে রাখতে তাই সংখ্যাগুরুকেও পথে নামতে হয়।
বিশ্বাস করি, এমন পরিস্থিতিতে জোটবদ্ধ মানুষই অবতার বা পয়গম্বর হবেন। সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব সংখ্যালঘুর আস্থা অর্জনে, আর কত বোঝাবে এ দেশ? গণতন্ত্রে কিন্তু দুর্বল কণ্ঠস্বরও শুনতে হয়, পরিণত রাজনৈতিক দলগুলি তা বুঝলে মঙ্গল। তা না হলে, জন-গণ-মন-জাগরণ ঘটবেই! যুগের পর যুগ লালিত মৈত্রী দু’একটি আইন দিয়ে ভাঙা যাবে না। কারণ, দেশের নাম ভারতবর্ষ!
(লেখক কনকনগর এস ডি ইনস্টিটিউশন, হিঙ্গলগঞ্জের প্রধান শিক্ষক)