চিন্তিত: কাশ্মীরে থাকা পরিজনদের ফোনে ধরার চেষ্টায় এ শহরের এক কাশ্মীরি ব্যবসায়ী। সোমবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
‘পোশ’ মানে ফুল, কাশ্মীরি ভাষায়! ‘পামপোশ’ মানে পদ্ম ফুল। উপত্যকার ডাল হ্রদ ভরে অজস্র পদ্ম ফুটে থাকে এ সময়ে। সেই অপরূপ দৃশ্য এ বছর দেখা হবে কি না, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না শ্রীনগরের আহমেদ বাট।
নিউ মার্কেটে ‘পামপোশ’ লেখা দোকানটির বয়স ১০০ পার করবে আর ছ’বছর বাদে। ইতিহাসের নানা ঝড়-বাদলেও মানবিকতা আর বন্ধুত্বের অটল স্মারক হিসেবে রয়ে গিয়েছে এই দোকান। শোকেসের বিজ্ঞাপনে কাশ্মীরি শালসজ্জিত প্রসেনজিৎ। সেই দোকানে বসেই আসন্ন ইদে বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তা গ্রাস করছে কাশ্মীরি যুবককে।
সংবিধানের ৩৭০ বা ৩৫এ ধারার খুঁটিনাটি নিয়ে এ যাবৎ মাথাই ঘামাননি দোকানের ম্যানেজার, মধ্য তিরিশের আহমেদ। ২০ বছর ধরে ব্যবসার কাজে কলকাতায় আসা-যাওয়া করছেন তিনি। কাঁচুমাচু মুখে বলছিলেন, ‘‘ব্যাপারটা ঠিক কী হল, রাজ্যসভা টিভি-র আলোচনা শুনে বোঝার চেষ্টা করছি।’’
তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, হঠাৎ আসা দুর্যোগে তাঁর জন্মভূমির সঙ্গে কর্মভূমি কলকাতার দূরত্ব কতটা অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছে! ইদের ছুটিটা শ্রীনগরে কাটাবেন বলে ৮ অগস্টের বিমানের টিকিট কাটা আছে! রবিবার বিকেলে শেষ বার কথা হয়েছিল স্ত্রীর সঙ্গে। তেরো বছরের ছেলে ও সাত বছরের মেয়ে তখন বাড়িতে ছিল না। এর পরে রাত থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত কত বার ফোনে চেষ্টা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। দোকানের মালিকেরাও সব কাশ্মীরে এখন। এমনকি, ল্যান্ডলাইনের নম্বরও মিলছে না। পাশের দোকানের মালিকদের তৃতীয় প্রজন্ম সাজ্জাদ হায়দর ফরিদের কথায়, ‘‘সেই ’৯০ সাল থেকে কাশ্মীরে গোলমালের আঁচ বেশ কয়েক বার কলকাতায় বসে টের পেয়েছি। কিন্তু ল্যান্ডফোনেও কথা বলা যাবে না, এমন দশা হয়নি!’’
নিউ মার্কেটে কাশ্মীরিদের দোকান। সোমবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
কাশ্মীরের বাড়িতে কী আছে, কী নেই, কে জানে! ভূস্বর্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত বিচ্ছিন্ন থাকাই এ শহরের কাশ্মীরি ভূমিপুত্রদের কাছে এখন পয়লা নম্বরের উৎকণ্ঠা। নিউ মার্কেটের কয়েকটি দোকানের গুটিকয়েক মালিক-কর্মচারী ছাড়া রয়েছেন মির্জ়া গালিব স্ট্রিটের ডজনখানেক লিজ়ধারী কাশ্মীরি দোকানমালিক ও তাঁদের অনুচর। বাংলা ও কাশ্মীরের মধ্যে সব থেকে বড় যোগসূত্র কাশ্মীরি শালওয়ালারা এখন বেশির ভাগই উপত্যকায়। মাস তিনেক আগেও যাঁদের সঙ্গে রিপন লেনের ডেরায় দেখা হয়েছে, সেই সুগায়ক আব্দুল কাইয়ুম দার, সু-রাঁধুনে নুর মহম্মদ দারদের মতো চেনা কাশ্মীরি শালওয়ালাদের ফোনে বারবার চেষ্টাতেও ধরা গেল না।
ধর্মতলায় জম্মু-কাশ্মীর পর্যটন ও এম্পোরিয়ামের সরকারি দোকানঘরেও থতমত মুস্তাক আহমেদ বাট, আব্দুল কাইয়ুম ওয়ানিরা। মুস্তাক বলছিলেন, ‘‘অমরনাথ যাত্রাতেও এ বার রেকর্ড সাড়ে তিন লক্ষ লোক হয়েছিল! পুজোয় কাশ্মীরে যেতে চান অসংখ্য মানুষ। হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেল!’’ নিউ মার্কেটে অ-বাংলাভাষী দোকানমালিকদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে বাংলায় খোশগল্প করতে অসুবিধা হয় না, তাঁদের মধ্যে সাধারণত সবার আগে কাশ্মীরি দোকানগুলি। সেখানেও আগামী দিন ঘিরে দুশ্চিন্তার আবহ। ‘‘এত সেনার দাপাদাপি! এ ভাবে কি ‘আমন’ আসবে উপত্যকায়?’’— নিউ মার্কেটের প্রবীণ কর্মচারী থেকে শালের গায়ের নকশা-শিল্পী, বদগাঁওয়ের তরুণদের গলায় একই সুর! ইদের ঠিক আগে ৩৭০ বিলোপের অভিঘাত সব মিলিয়ে বেসুরে বাজছে।
বছরখানেক আগে কলকাতায় এসে তাঁর ‘ইদের জামা’ কবিতাটি শুনিয়েছিলেন অনন্তনাগের মেয়ে, অ্যাকাডেমি যুব পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি নিঘাত সাহিবা। সংঘর্ষ, রক্তপাতময় পটভূমিতে সেই জামাগুলি চোখে দেখা যায় না, শুধু স্বপ্নে ভাসে। উৎসবের আগে কলকাতার কাশ্মীরি সহ-নাগরিকদের কাছেও প্রিয়জনের কাছে থাকার ইচ্ছেটুকু ধূসর হয়ে আসছে!