ছবি সংগৃহীত।
উত্তর কলকাতার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (এপিসি) রোড সংলগ্ন আস্ত একটা পাড়া। নাম ‘চানা গলি’! দুপুর থেকেই প্রবল ব্যস্ততা সেখানে। বিকেলের আগেই ডালায় চানা সাজিয়ে ফুটপাতের ঠিক করে রাখা জায়গায় গিয়ে বসার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে! শহরের চানার ব্যবসায়ীদের বড় অংশেরই বাস এখানে। সেই থেকেই ওই নাম।
এক দুপুরে সেখানে গিয়ে এক চানাওয়ালার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছাপ্রকাশ করতেই হতভম্ব তিনি। ঘরের বাকি বাসিন্দাদের সঙ্গে জোর আলোচনার পরে পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যকে ডেকে বললেন, ‘‘বাঙালিবাবুকা পাস লে যাও!’’ গলি, তস্য গলি পেরিয়ে সেই নাবালক যাঁর সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন, তিনি ‘চানা গলি’র একমাত্র বাঙালি বাসিন্দা। চোখে মোটা কাচের চশমা। মুখে হাজারো বলিরেখা। বয়স আনুমানিক আশি পেরিয়েছে। কানেও ভাল শুনতে পান না। আগন্তুককে দেখে বৃদ্ধ বলতে শুরু করলেন, ‘‘এ পাড়ায় আর বাঙালি নেই। বাঙালি কেউ এলেই ওরা আমার কাছে পাঠায়। আমিই এ পাড়ার শেষ বাঙালি চানাওয়ালা। ভাবুন, চল্লিশ-পঞ্চাশ ঘর বাঙালি চানাওয়ালার এই পাড়ার গোটাটাই বদলে গেল!’’
‘চানা গলি’র মতোই বদল ঘটে গিয়েছে শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হকারদের মধ্যে। ফুচকাওয়ালা থেকে চপ বিক্রেতা, চা দোকানি থেকে ডালায় ফল বা প্রসাধনী নিয়ে বসা ব্যক্তিদের মধ্যেও বাঙালি খুঁজে পাওয়া এই মুহূর্তে দুষ্কর। একমাত্র ট্রেনে আর কলকাতার কিছু পুরনো বাজারে বাঙালি হকারের দেখা মেলে। তাঁরাও সংখ্যায় হাতে গোনা বলেই মত অনেকের।
একই সঙ্গে বদল ঘটে গিয়েছে গাড়িচালকদের চরিত্রেও। ট্যাক্সি থেকে অটো, হাতে টানা রিকশা থেকে ভ্যান অথবা শহর-শহরতলির হালফিলের টোটোর নিয়ন্ত্রণও বহু জায়গায় অ-বাংলাভাষীদের হাতে। কিন্তু হঠাৎ এই বদল ঘটল কী করে? পাড়ার আড্ডায় অনেকেরই বক্তব্য, হঠাৎ করে নয়, এই পরিবর্তন হয়েছে ধীরে ধীরে। অর্থনীতির শিক্ষক থেকে সমাজতত্ত্বের শিক্ষকদের বড় অংশ যদিও বলছেন, ‘‘জীবন-জীবিকা নির্বাচনের মানসিকতায় বদল এবং স্বজাতির পাশে থাকার মনোবৃত্তিতে পরিবর্তনই এই বদলে যাওয়া ছবির জন্য দায়ী।’’
ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজারের হকার শ্যামল কর্মকারের দাবি, ‘‘৪০ বছর ধরে হকারি করছি। আমাদের আশপাশের বহু লোককে এই কাজ ছাড়তে দেখেছি। মূল কারণ, বাঙালি জীবনে নিশ্চয়তা খোঁজে। আমার বহু বন্ধুরই মনে হয়েছে, হকারির থেকে সরকারি একশো দিনের কাজ করা ভাল। আয় যা-ই হোক, হকারির থেকে একশো দিনের কাজেই জীবনে নিশ্চয়তা বেশি।’’ গড়িয়াহাট মোড়ের হকার ধনঞ্জয় সরকারের আবার দাবি, ‘‘জায়গা তো ফাঁকা থাকে না। আমাদের ছেড়ে যাওয়া জায়গাতেই ভিন্ রাজ্য থেকে আসা অন্যেরা ঢুকছেন।’’
মধ্য কলকাতার নন্দরাম মার্কেটের হকার সুনীল চৌরাসিয়ার আবার দাবি, ‘‘হকারির সঙ্গে আইনি না বেআইনি, সেই প্রশ্নও জড়িয়ে থাকে। ফুটপাতে বসার জন্য পুলিশের সঙ্গে যেমন সমঝোতা করে চলতে হয়, তেমনই পাড়ার দাদার ‘সহযোগিতা’ও দরকার হয়। দল বেঁধে ব্যবসা না করলে সেই সহযোগিতা কোথাওই পাওয়া যায় না।’’ কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য তথা হকার সংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবাশিস কুমারও বললেন, ‘‘সাধারণত ভিন্ রাজ্যের কোনও হকার একা আসেন না। যিনিই কলকাতায় হকারি করতে আসুন, দেখা যায় সঙ্গে ‘দেশের লোক’ রয়েছেন। তবে সেই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, এ রাজ্য অন্য যে কোনও রাজ্যের তুলনায় থাকা-খাওয়ার দিক থেকে অনুকূল। বাঙালির জীবিকা নিশ্চিত হচ্ছে বলেই হয়তো তাঁরা হকারি ছাড়ছেন।’’
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র যদিও মনে করেন, প্রবল ভাবে সংখ্যা কমলেও বাঙালি হকার কিন্তু একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, ‘‘সংখ্যা কমছে কারণ, বাঙালির ব্যবসায় ঝোঁকার ইচ্ছা বড়ই কম। বাঙালি তার গ্রাহক চরিত্র নিয়েই দিব্যি আছে!’’’