মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
কলকাতা পুরসভা পারেনি। হাওড়া পুরসভাও ডাহা ফেল। বিধাননগরও তথৈবচ। এমনকী, দক্ষিণ দমদম পুরসভার অন্যান্য ওয়ার্ডেরও একই অবস্থা। ব্যতিক্রম হিসেবে শুধু জ্বলজ্বল করছে সেখানকার ২৯ নম্বর ওয়ার্ড। প্লাস্টিক বর্জন করায় বাঙুরের ওই ওয়ার্ডের জল-ছবিটাই পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। ভারী বর্ষণ হলেও এখন আর ওই এলাকায় দীর্ঘক্ষণ জল জমে থাকে না। এই উদ্যোগের পিছনে যিনি প্রধান ভূমিকায়, তিনি ওই ওয়ার্ডেরই প্রাক্তন কাউন্সিলর মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। এখন যিনি কালিন্দীতে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেখানেও একই চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
এক বার ভারী বৃষ্টি হলে জল জমে থাকত বহু দিন। এটাই ছিল বাঙুর এলাকার চেনা ছবি। ১৯৯৯ সালে প্রথম কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরেই মৃগাঙ্কবাবু এই সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হন। ওয়ার্ডের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে প্লাস্টিক-বিরোধী অভিযানে নামেন তিনি। প্লাস্টিক কী ভাবে নিকাশি ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, বাসিন্দাদের তা বুঝিয়ে বলেন। বাসিন্দারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেরাই যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ করে দেন। ম্যাজিকের মতো বদলে যায় নিকাশির সমস্যা।
হাতে গোনা কিছু পুরসভা বাদ দিলে, প্লাস্টিক-বিরোধী অভিযানে প্রায় গোটা রাজ্যই যেখানে ডাহা ফেল, সেখানে কী ভাবে সফল হলেন তিনি?
মৃগাঙ্কবাবুর সাফ কথা, ‘‘সরকারি তরফে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে প্লাস্টিকের ব্যবহার চলবেই। বলা হচ্ছে, ৫০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু আমার মতে, মাইক্রনের হিসেব কষে লাভ নেই। সব ধরনের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগই নিষিদ্ধ করতে হবে। এলাকায় সেই ফর্মুলাতেই সফল হয়েছি।’’ প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে মৃগাঙ্কবাবুর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। কল্যাণবাবুর কথায়, ‘‘বাঙুরে ইদানীং জল জমে না। কারণ একটাই। ওখানে প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। মৃগাঙ্কবাবুর চেষ্টাতেই এই সুফল মিলেছে।’’
মৃগাঙ্কবাবুর কথায়, ‘‘আমার বাড়িও বাঙুরে। একটু বৃষ্টিতেই সেখানে জল জমত। কাউন্সিলর হওয়ার পরেই বুঝতে পারি, প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবেই জল জমার সমস্যা কমবে।’’ কাউন্সিলর হওয়ার পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে এলাকা-ভিত্তিক বৈঠক করেন মৃগাঙ্কবাবু। সকলকে বোঝান, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ শুধু নিকাশির পথই আটকায় না, পাশাপাশি স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে। প্লাস্টিক-বিরোধী অভিযানে মৃগাঙ্কবাবু সামিল করেন স্থানীয় তিরিশটি বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদেরও। তাঁর দাবি, ‘‘প্লাস্টিক বর্জনের প্রচারে লেকটাউন, বাঙুরে মানুষকে নিয়ে মিছিল করি। পরের বছর থেকেই তার ফল পাই। এখন আর এখানে জল জমে না।’’
অবাধেই প্লাস্টিকের ব্যবহার।
মৃগাঙ্কবাবু বাঙুরে যা পেরেছেন, অন্য জায়গায় তা সম্ভব হয় না কেন?
আইন অনুযায়ী, প্লাস্টিক ব্যবহারকারী দোকানের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করতে পারে পুরসভা। কিন্তু করে না। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (পরিবেশ) স্বপন সমাদ্দারের সাফাই, ‘‘মানুষ সচেতন না হলে শুধু আইন করে কিছু লাভ হবে না।’’
প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে একাধিক বার পুরসভাগুলিকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। ২০০৪ সালে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিব অমিতকিরণ দেব এক জরুরি নির্দেশ পাঠিয়ে পুরসভাগুলিকে সতর্ক করে জানান, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ব্যবহার রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে প্রতিটি শহরের নিকাশি ব্যবস্থা পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়বে। ২০০৬ সালে ফের তদানীন্তন মুখ্যসচিব জরুরি চিঠি পাঠিয়ে পুরসভাগুলিকে পরিবেশ দূষণ আইন প্রয়োগ করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এগারো বছর পার হলেও আইন খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে।
প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন দফতর ২০১৬ সালে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করে। ওই নির্দেশ অনুযায়ী, প্লাস্টিকের ক্যারিবাগ ব্যবহার করতে হলে কোনও সংস্থাকে পুরসভা বা পঞ্চায়েতের অনুমতি নিতে হবে। এ জন্য প্রতি মাসে স্থানীয় পুরসভা বা পঞ্চায়েতকে কমপক্ষে চার হাজার টাকা দিতে হবে। সেই অর্থ পুরসভা বা পঞ্চায়েত প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের কাজে ব্যবহার করবে। সেই নির্দেশ এখনও কলকাতা পুরসভা-সহ রাজ্যের কোনও পুরসভাতেই কার্যকর হয়নি। রাজ্যের নগরোন্নয়ন দফতরের সচিব ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, ‘‘কেন্দ্রের ওই নির্দেশাবলী সমস্ত পুরসভাকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোথায় কতটা মানা হচ্ছে, তা জানি না।’’