বিদায়: আসমতের দেহ নিয়ে পার্ক সার্কাসের আন্দোলনস্থলের সামনে তাঁর পরিজন ও অন্য আন্দোলনকারীরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
সপ্তাহ পাঁচেক আগের কথা। মল্লিকবাজার থেকে পার্ক সার্কাসমুখী মিছিলের পুরোভাগে হুইলচেয়ারে বসেই হাজির দৃপ্ত নারী। ফের পার্ক সার্কাসে অবস্থান গেঁড়ে বসা নিয়ে চিন্তিত পুলিশকর্তাদের চোখে চোখ রেখে তিনি বোঝাচ্ছিলেন, কেন এই মিছিলটা জরুরি।
হুইলচেয়ার-বন্দি সেই বড় বড় চোখের মেয়েকে দেখে তখন বোঝার জো নেই যে, আগের দিনই দীর্ঘ কেমো নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। আসমত জামিল জানতেন, পার্ক সার্কাসে কলকাতার নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী অবস্থানের বর্ষপূর্তিতে তাঁকে থাকতে হবেই। সেই মিছিলকে অবশ্য ফের অবস্থানের ভয়ে পার্ক সার্কাসের মাঠে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। তবে মঙ্গলবার, সরস্বতী পুজোর দুপুরের নিঃশব্দ মিছিলটিকে ঠেকানো গেল না। ফের পার্ক সার্কাসের মাঠে ঢুকলেন আসমত জামিল। তবে হেঁটে বা হুইলচেয়ারে বসে নয়! শেষ বারের মতো তাঁর চেনা মাঠে ধুলোর গন্ধে প্রতিবাদী মেয়েকে কফিনে শুইয়েই নিয়ে এলেন প্রিয়জনেরা।
দিল্লির শাহিন বাগের আদলে কলকাতার সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ অবস্থান মধ্য চল্লিশের আসমতের ডাকেই দানা বাঁধে। পার্ক সার্কাস ময়দান ও আসমত জামিল— ক্রমশ সমার্থক গোটা শহরের কাছে। সরস্বতী পুজোর চেনা ছবির বাইরে একরোখা, দৃঢ়সঙ্কল্প অন্য এক কলকাতাকেও দেখা গেল আসমতের টানেই। যাদবপুরের রত্না সাহা রায়, নিউ আলিপুরের শালিনী মিত্র বা সদ্য আইন পরীক্ষায় পাশ করা তরুণী শাফাকত রহিমদের পক্ষে এ দিন ঘরে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। গত বৃহস্পতিবারও রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁকে দেখতে আসা আন্দোলনের সঙ্গীদের বলেছেন, ‘‘আর কয়েক মাসেই আমি খাড়া হয়ে মাঠে নামব। আমি না থাকলেও আন্দোলন থামবে না!’’
গত বছরের গোড়ায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উপরে হামলার দিনেই শুরু হয় কলকাতার ‘স্বাধীনতা আন্দোলন-২’। ‘নো এনআরসি মুভমেন্ট’-মঞ্চের আহ্বায়ক অরূপ মজুমদার বলছিলেন, ‘‘আসমতেরা মাঠে ঢোকার দিন থেকেই আমরা পার্ক সার্কাস পরিবার।’’ গোবরার সমাধিক্ষেত্রে বাংলার প্রতিবাদী মেয়েকে সমাহিত করা হল। আসমতের স্বামী আব্দুল জামিল বলছিলেন, ‘‘পনেরো বছর ধরেই আসমতের শরীরটা কমজোরি, কিডনির গোলমাল। কিন্তু গরিব মেয়েদের জন্য নানা কাজ করত অক্লান্ত ভাবেই।’’ বছর তিনেক আগে তাঁর শরীরে এক আত্মীয়ার কিডনি বসানো হয়। তার পরেও ক্যানসারের থাবা। কেউ জানত না, পার্ক সার্কাসের মাঠে বাংলাকে একজোট করতে পথে নামাচ্ছেন যিনি, ক্যানসারে তাঁর জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ঘরোয়া মেয়ের ঝাঁঝালো বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন দেশের তাবড় গণ-আন্দোলনকর্মীরা। আন্দোলনে মাথা খাটিয়ে পদক্ষেপ করেছেন। অতিমারি না-ঘটলে আসমতদের কেউ সরাতে পারত না।
আসমতের বড় মেয়ে আলিশা ইতিহাসে এমএ পড়ছেন, মেজ ওয়ারিসা ডাক্তারি পড়ার চেষ্টায়, পুত্র হামজ়া সবে সপ্তম শ্রেণি। আসমতের সঙ্গীরা ভাবছেন, দরকারে ফের পথে নামতে হবে। স্ফুলিঙ্গের মতো ছোট্ট প্রতিবাদী-জীবন কলকাতার হৃদয়ে গভীর ছাপ রেখে গিয়েছে।