মানাসলুর ‘ট্রু সামিটে’ অরিজিৎ দে। —ফাইল চিত্র।
তাঁর রুকস্যাকের ওজন ২৮ কেজি! তাঁবু, গ্যাস, স্টোভ, শুকনো খাবার, স্লিপিং ব্যাগ, আইস অ্যাক্স থেকে অন্যান্য সরঞ্জাম— কী নেই তাতে!
বিপুল ভারী এই ব্যাগ বয়েই কখনও জ়ুমার টেনে এগোনো, কখনও মারণ ক্রিভাস পেরোনো। একাকী অভিযানে গন্তব্যে পৌঁছেও বিশ্রামের সুযোগ নেই। তাঁবু খাটানো থেকে খাবার বানানো, বরফ গলিয়ে জল তৈরি, বরফে তাঁবু ডুবে যাচ্ছে কি না সে দিকে রাতে ঘুমের মধ্যেও খেয়াল রাখা— সবই করেছেন একা। এ ভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও শেরপা ছাড়াই রবিবার বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম মানাসলুর (৮১৬৩ মিটার) ‘ট্রু সামিটে’ পৌঁছে গিয়েছেন শ্যামবাজারের অরিজিৎ দে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার অরিজিৎ বেসক্যাম্প থেকে বুধবার বললেন, ‘‘কষ্ট হয়েছে, পিঠে কালশিটেও পড়েছে। কিন্তু সামিটে পৌঁছে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছি। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরাও যে কম খরচে পাহাড়ে একক অভিযান করতে পারেন, সেই পথটাই চেনাতে চাই।’’
রবিবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ প্রথম বাঙালি হিসাবে মানাসলুর ‘ট্রু সামিটে’ পৌঁছন অরিজিৎ। তিনি জানাচ্ছেন, দারুণ আবহাওয়া দেখে ক্যাম্প ১ থেকেই সটান ক্যাম্প ৪ পৌঁছেছিলেন। শনিবার রাতের দিকে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। অন্যের ছেঁড়া তাঁবুতে রাত কাটান। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ সামিটের পথে বেরোন। সঙ্গে আরও তিন রাশিয়ার বন্ধু। শেষে রাশিয়ার এক পর্বতারোহী ও তাঁর নেপালি শেরপার সঙ্গে মানাসলুর ‘ট্রু সামিটে’ পৌঁছন এই বাঙালি যুবক। ক্যাম্প ৪-এ ফেরেন রাত ১১টায়। অরিজিতের কথায়, ‘‘সামিটের পথে ট্র্যাফিক এড়াতে সকালে যাত্রা শুরু করি। এ ছাড়া রাতে বেশি হাওয়া চললে অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া আমার সমস্যা হতে পারত।’’ এই অভিযানে বেসক্যাম্প পর্যন্ত আয়োজক সংস্থার সাহায্য (অর্থাৎ মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে খাবারের আয়োজন) নিয়েছেন তিনি। তার পরে এগিয়েছেন একা। তবে পথে ফিক্সড রোপের সাহায্য নিতে হয়েছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন অন্য আরোহী বন্ধুরাও। ফলে ১২-১৩ লক্ষ টাকার মানাসলু অভিযান তিনি সেরেছেন মাত্র আড়াই লক্ষ টাকায়!
বাংলার পিয়ালি বসাক, হিমাচলের বলজিৎ কৌর, পাকিস্তানের সাজিদ সাদপারা চলতি বছরে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্য ছাড়া একাধিক আট হাজারি শৃঙ্গ ছুঁয়েছেন। অক্সিজেন ও শেরপা, উভয়ের সাহায্য ছাড়া অন্নপূর্ণা শৃঙ্গে সাফল্যের মুখ দেখেছেন সাজিদ। তবে এভারেস্টে ‘সোলো’ অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন হাঙ্গেরির আরোহী সুহাজদা ৎজিলার্ড। তাই অরিজিতের এ রকম ‘সোলো’ সাফল্য অনেককেই দিশা দেখাবে বলে মনে করছেন বাংলার পর্বতারোহী রুদ্রপ্রসাদ হালদার। তাঁর কথায়, ‘‘এই সাফল্য বাংলা পর্বতারোহণে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে এই ধারায় অনেকেই পর্বতারোহণে উৎসাহী হবে। নতুন নতুন অনেকে উঠে আসবে।’’
গত দু’বছর মানাসলু থেকেই বিফল হয়ে ফিরেছিলেন বছর বত্রিশের অরিজিৎ। প্রথম বার শেরপাদের অসহযোগিতা, দ্বিতীয় বার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা রুখে দিয়েছিল। অরিজিৎ বলেন, ‘‘এটা শেরপারা বিশেষ ভাল চোখে দেখেন না। এ বারও বেসক্যাম্পে ওঁরা আমায় ‘সোলো ক্লাইম্বার’ বলে ডাকছেন, অন্য আরোহীদের সঙ্গে কথা বলতে দিতেও ওঁদের আপত্তি!’’
শ্যামবাজারের কাছে সরকারবাগানের বাসিন্দা অরিজিতের বাড়িতে আছেন মা-বাবা-দাদা। পর্বতারোহণ নিয়ে তাঁদের প্রশ্রয় না থাকলেও অ্যাডভেঞ্চারের জন্য চাকরি ছাড়তে দু’বার ভাবেননি অরিজিৎ। বরং পর্বতারোহণের খুঁটিনাটি শেখাতে খুলেছেন আস্ত ইনস্টিটিউট। বলছেন, ‘‘নিজেকে এক্সপ্লোরার বলতে চাই। পরবর্তী লক্ষ্য শীতে জমে যাওয়া নায়াগ্রা জলপ্রপাতে ক্লাইম্ব করা। তার পরে হয়তো ফিরব কখনও কোনও আট হাজারি পথে।’’