ধাপার চুল্লিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোভিড মৃতদেহ। নিজস্ব চিত্র
ফোনের ব্যক্তি: বিরজুনালা শ্মশান? সৎকারের ব্যাপারে কথা বলতে চাই। শ্যামবাজারের বেসরকারি হাসপাতালে আত্মীয় মারা গিয়েছেন।
শ্মশানকর্মী: ওই দিকের হাসপাতাল থেকে অনেক দেহ আসে। ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করেছেন বলে কিছু ছাড় দেওয়া হবে। দেহ তাড়াতাড়ি দাহ করতে চান, না কি আরও কিছু করার ইচ্ছে আছে?
ফোনের ব্যক্তি: কী কী করা যায়?
শ্মশানকর্মী: তিন হাজার টাকা দিলে লাইন দিতে হবে না। আগে সৎকার হবে। সৎকার দেখতে চাইলে জন-পিছু পাঁচশো টাকা করে দিতে হবে। দেহের সঙ্গে পছন্দের জিনিস দিতে বা সৎকারের আগে শেষ ছবি পেতে লাগবে আড়াই হাজার টাকা। চিতাভস্ম নিলে আরও দেড় হাজার। আট-দশ হাজার টাকা খরচ করতে পারলেই সব একেবারে ভাল ভাবে হয়ে যাবে।
ফোনের ব্যক্তি: এত টাকা?
শ্মশানকর্মী: অনেক কমই বলা হয়েছে। ক’দিন আগে ১৫-২০ হাজার টাকার রেট চলছিল। তা ছাড়া, হাসপাতালের যাঁর থেকে নম্বর পেয়েছেন, তাঁকে দিতে হবে, পুরসভার লোকও ভাগ নেবেন।
সদ্য মৃতের আত্মীয়ের পরিচয় দিয়ে এক দুপুরে খোঁজ করে জানা গেল, শহরে এ ভাবেই রমরমিয়ে চলছে সৎকারের ব্যবসা। অভিযোগ, সবটাই চলছে পুরসভা, হাসপাতাল এবং শ্মশানকর্মীদের একাংশের যোগসাজশে। সেই সূত্রেই এক শ্মশানকর্মীর সঙ্গে উপরের ওই কথোপকথন (সেই রেকর্ডিং রয়েছে আনন্দবাজারের কাছে)। কোভিড-দেহ হলে সময়ে দাহ না হওয়ার ভয় দেখিয়ে প্রথমে টাকা দাবি করছেন হাসপাতালের কর্মীরা। সেই টাকা নিয়ে সহজে কাজ নামানোর জন্য দেওয়া হচ্ছে পুরসভা ও শ্মশানের কর্মীর নম্বর। তাঁরাও নানা অছিলায় টাকা তুলছেন বলে অভিযোগ। ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ পেতেও খসছে হাজার হাজার টাকা।
অথচ, চলতি মাসে রাজ্য সরকারের নয়া নির্দেশিকা সামনে আসার পরে অন্তত এমন হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, সেই নির্দেশিকায় বলা আছে, আত্মীয়েরা ইচ্ছে করলে কোভিডে মৃতের দেহ নিজেদের শহর বা গ্রামে নিয়ে সৎকার করতে পারেন। তবে কোনও মতেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই নোডাল অফিসারের অনুমোদন লাগবে। যাবতীয় কোভিড-বিধি মেনে সৎকারে ছ’জনের বেশি লোক থাকতে পারবেন না।
অভিযোগ, ওই নির্দেশ অগ্রাহ্য করেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে সৎকারের নামে ব্যবসা। যেমন, গত শনিবারই বি টি রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয় কাশীপুরের শ্যামসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির। হাসপাতাল থেকে পরিবারকে জানানো হয়, দেহ সেখানে থাকলে কোভিড পরীক্ষা করাতে হবে। পজ়িটিভ এলে দেহ পাওয়া যাবে না। আর তিন হাজার টাকার বিনিময়ে কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই দেহ নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে গেল ওই পরিবার। হাসপাতাল থেকে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা হল নিমতলা শ্মশানে সৎকারের। চার হাজার টাকার বিনিময়ে রাতভর লাইন দেওয়ার ঝক্কি এড়িয়ে আগেই দাহকাজ সেরে ফেলা গেল।
একই অবস্থা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত শুক্রবার মৃত্যু হওয়া সুন্দর ঘোষালের। তাঁর বাড়ির লোকেদের ইচ্ছে ছিল, পারিবারিক রীতি মেনে গিরিশ পার্কের বাসিন্দা সুন্দরবাবুরও নিমতলা শ্মশানে সৎকার হোক। কিন্তু ওই দিন হাসপাতাল থেকে কোভিড-দেহ নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে পুরসভা সব দেহই হয় বিরজুনালা, নয়তো ধাপায় নিয়ে যেতে বলে। ওই হাসপাতালেরই এক কর্মীর দেওয়া নম্বরের ভিত্তিতে সমস্যা মেটে। তাতে ফোন করা হলে এক ব্যক্তি নিজেকে পুরসভার কর্মী পরিচয় দিয়ে বলেন, “ইচ্ছেপূরণ হবে। তবে আমাদের সে জন্য কিছু দিতে হবে!” শেষে মৃতের পরিবার পাঁচ হাজার টাকার বদলে নিমতলায় সৎকারের সুযোগ পায়।
এমন একের পর এক অভিযোগ সামনে আসার পরেও পুর প্রশাসন কেন সতর্ক হচ্ছে না? পুরসভার কেউই এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য তথা পুর স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতীন ঘোষকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। উত্তর দেননি মেসেজের। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিক অবশ্য বললেন, “এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যাঁদের এমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে, দয়া করে আপস না করে তাঁরা পুলিশে জানান, স্বাস্থ্য কমিশনে অভিযোগ করুন।” লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশকর্তারও মন্তব্য, “নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে বেহালার বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এ ভাবেই টাকার বিনিময়ে বাবার দেহ বার করে নিয়ে যেতে পারা সুনীল সামন্ত নামে এক ব্যক্তির প্রশ্ন, “ওই রকম একটি মুহূর্তে প্রিয়জনের পচতে থাকা দেহটিকে আগে সসম্মানে বিদায় দেব, না কি অভিযোগ করার জন্য দৌড়ব? কোভিডে মৃতের পরিবারের কি আদৌ সেই সুযোগ থাকে? এত অভিযোগ বার বার সামনে আসার পরেও প্রশাসন নিজেই কেন কড়া হবে না?”