নন্দনে ইয়ানা কালমিকোভা। শনিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারপার্সন, প্রবীণ রুশ চিত্র পরিচালক পাভেল লুঙ্গিন তখন গুটিগুটি পায়ে নন্দন থেকে শিশির মঞ্চে সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা শুনতে চলেছেন। যুদ্ধের জন্য ঘরছাড়া ইউক্রেন-কন্যা ইয়ানা কালমিকোভা নন্দন চত্বরেই তাঁর নেপালি চিত্র পরিচালক বন্ধু রাজন কাথেটের সঙ্গে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছিলেন। অধুনা পর্তুগালবাসী ইয়ানা কলকাতা চলচ্চিত্র ফিল্ম উৎসবের একমাত্র ইউক্রেনীয় ছবির প্রযোজক। শনিবার একটুর জন্য প্রতিযোগিতার রুশ বিচারক এবং ইউক্রেনীয় প্রযোজকের মুখোমুখি দেখা হল না।
তবে বিচারকমণ্ডলীর রুশ প্রধানের নাম শুনে ইয়ানার চোয়াল খানিক শক্ত হল। একটু থেমে বললেন, “হুম! কালই আমার সহ-প্রযোজকের মুখে ব্যাপারটা জানলাম! আমার খুব রাগ হচ্ছে। তবে কী জানেন, এই ছবিটা তো দেশের সঙ্কটকালে আমায় সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে সক্কলকে দেখাতেই হবে, তাই না…!” শুক্রবার নিউ টাউনে নজরুল তীর্থের পরে শনিবার নন্দনেও কলকাতা দেখল এ বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে মুক্তিপ্রাপ্ত ইউক্রেনের ছবি ‘উই উইল নট ফেড অ্যাওয়ে’। যুদ্ধের দিনকালে ইউক্রেনের রুশ অধিকৃত দনবাস অঞ্চলের পটভূমিতে এ ছবি জুড়ে সত্যিই ছোট্ট দেশ ইউক্রেনের মুছে না-যাওয়ার তাগিদ। ছবির তরুণী পরিচালক আলিসা কোভালেঙ্কো নিজে ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এ ছবির শুটিংয়ের পরে যুদ্ধের জন্যই এডিটিং পর্ব থমকে যায়। যুদ্ধ থেকে ফিরে ২০২২-এর নভেম্বরে আলিসা সম্পাদনার টেবিলে বসেন। তড়িঘড়ি ছবি শেষ করে গত ফেব্রুয়ারিতে বার্লিনে প্রথম প্রদর্শন। “বার্লিনে পুরস্কার না-এলেও তিনটি বিভাগে বাছাই তালিকায় আমরা ছিলাম”— সগর্বে বললেন ইয়ানা।
এ ছবি দেখতে দেখতে যুদ্ধধ্বস্ত বাস্তব এবং সাজানো চিত্রনাট্য প্রায় মিশে গিয়েছে মনে হয়। ইয়ানা বলছিলেন, “তথ্যচিত্রের মতোই অপ্রত্যাশিত কত কিছু যে ঘটেছে। শুটিংয়ের সময়ে বোমা, গুলির বিকট শব্দ। ছবিটার কোনও সাউন্ড ডিজাইন নেই। যুদ্ধের বিস্ফোরণের শব্দ আপনিই ঢুকে পড়েছে!” এ ছবির গল্প দনবাসে ২০১৪ থেকে রুশ হামলার পটভূমিতে ফাঁদা হয়েছে। যুদ্ধধ্বস্ত দেশে নিষ্ফল ভবিষ্যতের যন্ত্রণা ভুলে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী মুক্তির খোঁজে নেপাল হিমালয়ে অভিযানে চলেছেন। অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে পৌঁছে তাঁদের ভাঙাচোরা জীবন এক অন্য পূর্ণতা খুঁজে পাচ্ছে। ইয়ানা বললেন, “ছবির অভিনেতাদের মধ্যে লিজা এবং লেয়া এখন ইউরোপে। ইলিয়া রয়েছেন রুশ দখলে থাকা জোলোতে শহরে। ছবিতে যে গ্রামটা দেখলেন, রুশরা তা শেষ করে দিয়েছে!” সাবেক সোভিয়েত জমানায় ইয়ানার জন্ম কিন্তু রাশিয়ার সাইবেরিয়ায়। বাবা রুশ, মা ইউক্রেনীয়। জীবনের পনেরোটা বছর রাশিয়াতেই ছিলেন ইয়ানা। “তা হোক, কিন্তু আমাদের পরিবার এখন মনেপ্রাণে ইউক্রেনের! আমি দুঃখিত, যা পরিস্থিতি, তাতে রুশ সরকার এবং সাধারণ মানুষদের তেমন আলাদা করে দেখতে পারছি না!”
১২ এবং ১৭ বছরের দুই ছেলের একক অভিভাবিকা ইয়ানা গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ওডেসায় তাঁর ঘরের জানলা খুলে রকেট বিস্ফোরণ দেখেন। “বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই দেশ ছেড়েছি”, বলছেন ইয়ানা। পর্তুগাল থেকে অনলাইনে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পড়ানো, ছবি প্রযোজনার নানা কাজ চালিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াইও চলছে তাঁর। বলছেন, “আমাদের দেশে কিন্তু সিনেমা, থিয়েটার, অপেরা বন্ধ হয়নি। কিভে ক’দিন আগেই বিপুল ড্রোনহানা হয়ে গেল! কিন্তু সিনেমাও আমাদের কাছে প্রতিবাদেরই মাধ্যম।”
ইয়ানাদের ছবি প্রতিযোগিতায় দাগ কাটবে কি না, বলা শক্ত! তবে সেই প্রতিবাদের ফুলকি এ বার কলকাতার তরুণ শীতের উত্তাপ আরও একটু সজীব করে গেল।