শহরে আফগান খাবার মেলা নিয়ে বাড়ছে সংশয়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
‘‘কার দোষে দেশটার আজ এই অবস্থা? আমেরিকা এত দ্রুত সেনা সরিয়ে নিয়ে কি ঠিক করল?’’— কাবুলি নানে কামড় দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন মধ্যবয়স্ক মহিলা। সঙ্গী চার জনের মধ্যে দু’জন ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে আমেরিকাকেই কাঠগড়ায় তুললেন। আর এক সঙ্গী অবশ্য বললেন, ‘‘কে দোষী তা খোঁজার চেয়ে আমি বরং ওখানকার মেয়েদের কী পরিণতি হতে চলেছে, সেটা নিয়েই বেশি ভাবছি!’’
সল্টলেকের কাফিলা রেস্তরাঁর ভিড়ে তখন শুধুই অশান্ত আফগানিস্তানের কথা। হবে না-ই বা কেন? এ রেস্তরাঁর থিমের সঙ্গেই জড়িয়ে কাবুলিওয়ালাদের দেশ। খাবারের মেনু থেকে অন্দরসজ্জার নকশা, রেস্তরাঁয় সর্বক্ষণ বাজতে থাকা সুর— সবেতেই আফগান ছোঁয়া। রেস্তরাঁর অন্যতম অংশীদার অভিষেক জয়সওয়ালের অবশ্য কাবুল-আলোচনায় মন নেই। তাঁর বরং চিন্তা, মাস কয়েক পরে এমন থিম ধরে রেখে রেস্তরাঁ চালানো যাবে তো?
এমন ভাবছেন কেন? অভিষেকের ব্যাখ্যা, ‘‘অন্দরসজ্জা যা-ই হোক না কেন, রেস্তরাঁ চলে তার খাবারের জন্য। আমাদের এখানে ‘আফগানি কলমি’, ‘কান্দাহারি লাহাম’, ‘দেজ়ায়ে মশলুক’ বা ‘কিধনু গোস্ত’-এর মতো জিভে জল আনা আফগান খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু এ সব রান্নার জন্য যে মশলা লাগে, তা সরাসরি আসে আফগানিস্তান থেকে। দেশটায় যদি এমন অশান্ত পরিবেশ থেকে যায় তা হলে মশলা আসবে কী করে? এখানকার মশলায় তো আফগান খাবার বানিয়ে খাওয়ানো যাবে না!’’
একই রকম দাবি সিআইটি রোডের রেস্তরাঁ আফগানির মালিক জ়াকির হোসেনের। তিনি বললেন, ‘‘অনেকে শুকনো ফলের কথা বলছেন বটে, কিন্তু পাকাপাকি ভাবে মশলা আসা বন্ধ হয়ে গেলে অনেক লোভনীয় খাবারই কিন্তু আর মিলবে না। তেমন হলে আমাদের রেস্তরাঁ বন্ধ করে দিতে হবে। শেষ বার যা মশলা আনানো হয়েছিল, তাতে বড়জোর আর দু’মাস রেস্তরাঁ চলবে।’’
আফগানিস্তান থেকে এ দেশে মশলা আমদানির ব্যবসায় যুক্ত, বড়বাজারের হামিদ রাজা বলছেন, ‘‘আফগানিস্তান থেকে আনা মশলা তো শুধু রেস্তরাঁয় নয়, অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়। আফগানিস্তানের এই অশান্ত পরিস্থিতি যে দিন থেকে শুরু হয়েছে, তখন থেকেই মশলার দামের ঠিকঠিকানা নেই। অনেকেই গুদামে মশলা জমিয়ে রাখছেন, পরে বেশি দামে বিক্রি করবেন বলে।’’
এক সময়ে কাবুলিওয়ালাদের আনাগোনার জন্য বিখ্যাত ছিল মধ্য কলকাতার জ়াকারিয়া স্ট্রিট। সেখানে একাধিক দোকানে আজও আফগানি খাবারের রমরমা— আফগানি টিক্কা, আফগানি বিরিয়ানি বা পোলাও তো বটেই, আফগান চাঙ্গেজ়ি, আফগান মুর্গান, আফগান কাবাব খেতে যে কোনও উৎসবের মরসুমে ভিড় লেগেই থাকে। জ়াকারিয়া স্ট্রিটের এক দোকানের মালিক রহিম সিদ্দিকি বললেন, ‘‘মশলার আকাল তো রয়েছেই। কিন্তু মশলা আসবে কি না বা ব্যবসা করতে পারব কি না, তার চেয়েও এখন বড় প্রশ্ন— আফগানিস্তানে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন কি না।’’ পাশেই দাঁড়ানো, রহিমের দোকানের কর্মচারী প্রৌঢ় মহম্মদ সিরাজ আবার বললেন, ‘‘কোনও দেশের খাবার খেতে খেতে সেই দেশটার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার গল্প করতে হলে কি আর রসনার তৃপ্তি হয়?’’