‘আমাদের প্রশাসনটা তো চলছেই মা কালীর হাত ধরে’

পড়শি রাজ্য উৎকলে জগন্নাথদেবকে একাধারে ইষ্টদেবতা ও রাষ্ট্রদেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি অনেক সময়েই ধম্মো-কম্মের কথা কবুল করতে লজ্জা পায়।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০২:২০
Share:

কলকাত্তাওয়ালি: উদ্বোধনের প্রতীক্ষায় ‘ফাটাকেষ্টর’ পুজো মণ্ডপ (নব যুবক সঙ্ঘ) । ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

লালবাজারে গোয়েন্দা বিভাগের ডাকাতি দমন শাখার ভিতরের ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে মা কালীর পেল্লায় এক ছবি। জনৈক জাঁদরেল বড়বাবু রুপোর ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন সেটি। ডিউটির ফাঁকে ঠিক সময় করে চলে যেতেন বাগবাজারের মা সিদ্ধেশ্বরীর থান কিংবা শ্মশানকালী-খ্যাত কাশী মিত্তির ঘাটে। সে বার ‘সোর্স’ মারফত পাক্কা খবর পেলেন, বড়বাজারে ব্যাঙ্ক ডাকাতির ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’ বিহারের মুন্না ডাকাত কালীঘাটে মানতের জোড়া পাঁঠা বলি দিতে এসেছে।

Advertisement

এটা বছর দশেক আগের কথা। কলকাতা জুড়ে বরাবরই অপরাধ এবং অপরাধ দমন— দু’টি বৃত্তেই মা কালীর অবাধ বিচরণ। একদা এই শহরও লালমোহনবাবুর ভাষায় রীতিমতো ‘ডেকয়েটস ইনফেস্টেড’ ছিল। কাশীপুরে মা চিত্তেশ্বরীর বিশেষ খাতির ছিল শহরের ডাকাতদের মধ্যে। চিত্তেশ্বরী অবশ্য কালী নন, দুর্গা। চিৎপুরের মা চিত্তেশ্বরীর পুজো দিয়ে তখন নিয়মিত জোড়াসাঁকো বা বৌবাজার পাড়ি দিত দুর্বৃত্তেরা। কালীঘাটে তখন গভীর জঙ্গল। তবু কালীঘাটের কালীকে ঘিরে তেমন ডাকাতির গল্প শোনা যায় না।

পড়শি রাজ্য উৎকলে জগন্নাথদেবকে একাধারে ইষ্টদেবতা ও রাষ্ট্রদেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি অনেক সময়েই ধম্মো-কম্মের কথা কবুল করতে লজ্জা পায়। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের আদর্শ মেনে বাম আমলে থানা-টানায় কালীপুজো করতে নিষেধও জারি করা হয়েছিল। তবু এখনও পুলিশের বিভিন্ন আবাসনে, এমনকি কিছু থানার বাইরে মা কালীর দাপট দিব্যি মালুম হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার নিজে পয়লা জানুয়ারি এক বার বাড়ির কাছে কালীঘাটে যাবেনই!

Advertisement

কলকাতা পুলিশের বহু নামী অফিসারই শনি-মঙ্গলবার ঠিক কালীঘাটে ঢুঁ মেরে আসেন। তবে এখনও সাধারণত থানার বড়বাবুর ঘরের দেওয়াল কালীর ছবিবিহীনই থাকে। কোথাও ছবি থাকলেও কালী সেখানে ক্যালেন্ডাররূপিণী। ‘‘কিন্তু ওসি-র টেবিলের কাচের নীচে মা কালীর ফটো রাখাটা আমার একেবারে অপছন্দ। এ কী অসভ্যতা! মাকে পুজো করবে, আবার তাঁর মুখের উপরে এঁটো চায়ের কাপ ঠক করে নামিয়ে রাখবে?’’ বলে ওঠেন কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়। সেই কবে হাওড়ার সুপার থাকার সময় থেকে যখন যেখানে থেকেছেন, সেখানে তো বটেই, এমনকি লাউডন স্ট্রিটে পুলিশ কমিশনারের বাড়িতেও নিষ্ঠা ভরে কার্তিক অমাবস্যায় কালীপুজো অটুট রেখেছেন প্রসূন।

বাম আমলেও বডিগার্ড লাইন্সের জনৈক ‘তান্ত্রিক’, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ‘ঘটকবাবু’র নামডাক শোনা যেত। তাবড় বাম নেতারাও তাঁকে হাত দেখাতে আসতেন। ঘটা করে কালীপুজো হত তাঁর বাড়িতেও। একদা কলকাতার পোড়খাওয়া গোয়েন্দা অফিসার, বহু থানার দুঁদে ওসি অভ্রান্তবন্ধু মজুমদার এখনও জোর গলায় বলেন, ‘‘আমি বরাবর ভেবে এসেছি, আমাদের প্রশাসনটা তো চলছেই মা কালীর হাত ধরে!’’ একদা এন্টালির ওসি-র গল্প, কালীপুজোর রাতে বরাবরের মতো মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে অঞ্জলি দিতে ডিসি-র কাছে ঠিক দেড় ঘণ্টার ছুটি চেয়েছিলেন। ডিসি রাজি হননি। কিন্তু ওসি-কে ঠেকায় কে! অসুস্থ লাগছে, ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে সটান বাগবাজারমুখো হলেন। আবার অঞ্জলি সেরে ‘ফিলিং ওয়েল নাও’ খবর পাঠিয়ে ফের সহাস্যে হাজির তিনি।

শোনা যায়, গোপাল পাঁঠাও দিনের প্রথম পাঁঠাটি মা কালীকে নিবেদন করে মাংসের দোকানের কারবার শুরু করতেন। কলকাতার কালীপুজোয় আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ফাটাকেষ্ট’ বা কুঁদঘাটের ‘বোম’দের কথা মনে পড়বেই। কেওড়াতলায় বিখ্যাত ছিল শ্মশান স্বপনের শ্মশানকালীর পুজো। আর পাইকপাড়ার উমাকান্ত সেন লেনে কালীমন্দির গড়েছিলেন সেকালের ‘গুন্ডা’ সুকুমার। অভ্রান্তবন্ধুর মতে, ‘‘যাঁরাই অস্ত্র নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাই কালীর ভক্ত।’’ শ্মশানকালীর কাছে নিভৃতে প্রার্থনা করতে গিয়ে ডিসি-র ফোন এল, কী একটা বড় গোলমাল হয়েছে। জনতাকে সামলানো যাচ্ছে না। এলাকার লোকের পরিচিত ওসি পুজো সেরে ‘স্পট’-এ পৌঁছতেই পাবলিক ঠান্ডা, ডিসি খুশ! ওসি-র বিশ্বাস, আসলে মা কালীই বাঁচিয়ে দিলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement