ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই নিয়েই আমার পাড়া। প্রত্যেকের জীবন কাহিনির নেপথ্যে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকে তাঁর নিজের আশপাশটা। আমার পাড়া চেতলার শঙ্কর বসু রোডে আমি খুঁজে
পাই নির্ভরতা, সম্পর্কের উষ্ণতা আর নিরাপত্তা।
পাড়ার চৌহদ্দি বেশ বড়। চেতলা রোড থেকে শুরু হয়ে শঙ্কর বসু রোড গিয়ে মিশেছে গোবিন্দ আঢ্য রোডে। রাস্তাটি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, তার নাম ধানক্ষেতি। আগে নাকি সেখানে ধান চাষ হতো। সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় বহুতল। এক কালে চেতলা অঞ্চলটা ছিল শহরের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে বিছিন্ন। তাই এই অঞ্চলে কেউ আসতে চাইতেন না। অতীতে আদিগঙ্গার উপরে ছিল কাঠের ব্রিজ। পরবর্তী কালে কংক্রিটের ব্রিজ তৈরি হওয়ায় শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হল।
দেখতে দেখতে বদলে গেল এখানকার ছবিটা। তৈরি হল বহুতল, বাড়ল লোকসংখ্যা, এলো উন্নয়ন। এ ভাবেই এলাকার আমূল পরিবর্তন ঘটল। রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ অঞ্চলেরই মানুষ। তিনি এলাকাবাসীর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক রেখে চলেন। তাঁর উদ্যোগে এলাকার নেক উন্নতিও হয়েছে। বর্তমান কাউন্সিলরও ভাল কাজ করছেন। সমস্যার কথা জানালে সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। এখন রাতেও পাড়াটা আলো ঝলমলে। দিনে দু’বার রাস্তা পরিষ্কার হওয়ায় পাড়াটা পরিচ্ছন্ন থাকে। এলাকায় নেই মশার উপদ্রব কিংবা জল
জমার অসুবিধে।
এত ভালর মধ্যে অবশ্য কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন পার্কিং। রাস্তার দু’ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। অনেকেরই বাড়ির সামনে অন্যের গাড়ি রাখা। ফলে নিজেদের গাড়ি রাখতে মাঝেমধ্যেই সমস্যা হয়। এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও কিছুটা উন্নত হলে বাসিন্দাদের যাতায়াতে সুবিধা হয়।
এখন পাড়ায় বহুতলের সংখ্যাই বেশি। আগে এ পাড়ায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের বসবাস থাকলেও এখন এসেছেন অভিজাতরা। বাড়তে থাকা জমি ও বাড়ির দামের জন্য এ পাড়ায় নতুন যাঁরা আসছেন তাঁরা হয় অবাঙালি অথবা আর্থিক সঙ্গতিপন্ন বাঙালি। পুরনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালই যোগাযোগ আছে। তবে নতুনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম কোথায়?
পরিবর্তন সত্ত্বেও পাড়া-পাড়া আবহাওয়াটা এখনও হারিয়ে যায়নি এখান থেকে। প্রতি দিন সন্ধ্যায় কিছু মানুষকে তাস খেলতে দেখা যায়। পাড়ায় রয়েছে একটি চায়ের দোকান। সেখানে সেই কাকভোরে উনুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পাড়ার আনাচ-কানাচে। অনেকেই সকাল সকাল চায়ের দোকানে আড্ডায় সামিল হন। এ ছাড়াও কালী মন্দিরের চালাতে কিংবা মণি সান্যাল পার্কের গায়ে বসার জায়গায় আড্ডার ছবি চোখে পড়ে। আড্ডাটা আছে বলেই বাসিন্দাদের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। এক দিন না গেলেই
আড্ডাটা কেমন যেন আমাদের টানে। এমনই এর গুণ!
এখানকার যুব সম্প্রদায় পাড়ার নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিপদে-আপদে সমস্যায় তাঁদের পাশে পাওয়া যায়। পাড়ার কয়েকটি ক্লবের উদ্যোগে কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি, রক্তদান শিবির এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়ে থাকে। আগের তুলনায় কমেছে ছোটদের খেলাধুলোর সময়। কাছেই সেন্ট্রাল পার্ক কিংবা মণি সান্যাল পার্কে ছোটদের খেলতে দেখা যায়। চেতলার বাস্কেট বল খেলা বরাবরই বিখ্যাত। বেশ কিছু ক্লাবের উদ্যোগে হয় বাস্কেট বল প্রশিক্ষণ শিবির। এ ছাড়াও আছে ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। হয় ফুটবল ট্যুর্নামেন্টও। পাড়া এবং আশপাশের এলাকায় রয়েছে নাট্য চর্চার ঐতিহ্য। চেতলা কৃষ্টি সংসদ ছোটদের নিয়ে প্রতি বছর নানা ধরনের নাটক
মঞ্চস্থ করে।
এ পাড়ার পুজো-পার্বণও কম আকর্ষণীয় নয়। কথিত আছে এ অঞ্চলে ডাকাতের বসবাস ছিল। এখানে বরাবরই কালীপুজোর প্রচলন বেশি। ২৪ পল্লির দুর্গাপুজো ও কালীপুজোর পাশাপাশি মণি সান্যাল পার্কে হয় দুর্গাপুজো। কাছেই সব্জি বাগান লেনে রয়েছে একটি প্রাচীন শীতলা মন্দিরও।
এতগুলো বছর এ পাড়ায় কাটিয়ে নিজের আজান্তেই এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে প্রতিবেশী, পরিবেশের সঙ্গে। এমন পাড়া ছেড়ে কি অন্যত্র যেতে কারও মন চায়?
লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক