লিলি চক্রবর্তী
শহরের ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে উত্তর কলকাতার কথাই প্রথমে মনে আসে। আর আমাদের রাজবল্লভ পাড়া তো অসামান্য ঐতিহ্যমণ্ডিত একটা এলাকা। কাছেই গঙ্গা। বড় রাস্তার মাঝখানে গিরিশচন্দ্র ঘোষের বাড়ি। এলাকাটা ঘিরে রয়েছে সারদাদেবীর মন্দির, নিবেদিতা গার্লস স্কুল, বলরাম মন্দির। সেই সব জায়গায় বহু বার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের পায়ের ধুলো পড়েছে। পুরনো পুরনো বাড়ি সব! আদি উত্তর কলকাতার আসল গন্ধটা বেশ পাওয়া যায় এখানে।
আমি যখন এ পাড়ায় আসি, সেটা মোটামুটি ১৯৬২ সাল হবে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। আমার জন্ম কলকাতায়, ছোটবেলাটা বাবার কর্মসূত্রে মধ্যপ্রদেশে কাটিয়েছি। বিয়ের পরে আমার স্বামী লিজে রাজবল্লভ পাড়ার এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন। এলাকাটা তো দারুণ। কিন্তু দোতলা সেই বাড়িটা খুব একটা ভাল অবস্থায় ছিল না। আমার স্বামীই বাড়িটাকে সারিয়ে ছিলেন। তখন আমার প্রায় রোজই শ্যুটিং থাকত এ দিক-ও দিক। যে দিন বাড়িটাতে ঢুকি, সেটা খুব সম্ভবত একটা রথের দিন ছিল। পুজো সেরে সে দিনও শ্যুটিং-এ গিয়েছিলাম।
রাজবল্লভ পাড়ার প্রধান একটা চরিত্রই হল চায়ের দোকানের আড্ডা। যদিও আমি পাড়ায় সে ভাবে মেশার সুযোগ পাই না, বা পাইনি, কাজের কারণে। কিন্তু প্রায় রোজই দেখেছি চায়ের দোকানের তুমুল আড্ডা এবং দাবাখেলা। তাতে সব বয়সের মানুষেরা অংশ নেয়। এখনও তেমনটা চলে। তবে সেই আড্ডার ভিড়টার বয়স বেড়ে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মও থাকে কিছু। কিন্তু তারা বেশির ভাগই বাইরের ছেলেপুলে। এখনকার ছেলেমেয়েরা হয়তো ওই ভাবে পাড়ায় বা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আড্ডা দেওয়াটাকে সময় নষ্ট বলে মনে করে।
কয়েক বছর আগে বেশ পুরনো একটা বাড়ি ভাঙা পড়েছিল। তা থেকে একটা বহুতল হয়েছিল। তাতে কিছু বসতবাড়ি, কিছু দোকানপাট আছে। এক সময়ে হয়তো এই পুরনো বাড়িগুলো এক এক করে ভাঙা পড়বে। আর রাখা সম্ভব হবে না। রক্ষণাবেক্ষণের বেশ সমস্যা তো রয়েছে সত্যিই!
এলাকাটা কিন্তু বেশ সবুজ, দেখতে আরও ভাল হয়ে গিয়েছে কিছু বছর ধরে। গাছগাছালিও রয়েছে যথেষ্ট। তবে আগে কিছু শিউলি ফুলের গাছ ছিল। সেগুলো বোধ হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মোটের উপরে সবুজের কমতি নেই।
একটা গুরুতর সমস্যা ছিল কিছু দিন আগে পর্যন্ত। আমার বাড়ির উল্টো দিকে একটা পার্ক আছে, গৌরীমাতা উদ্যান। তার পাশেই খোলা ভ্যাট ছিল। নোংরা-আবর্জনায় নরকের মতো হয়ে থাকত। দুর্গন্ধে হাঁটা যেত না। অনেক বার বলেও কোনও কাজ হয়নি। পাশেই একটা বস্তি আছে। সেখানকার বাচ্চারা সব রাস্তার উপরেই মলমূত্র ত্যাগ করে নোংরা করে রাখত। এমনই অবস্থা ছিল যে হাঁটা-চলা করতে হত সাবধানে, ওই সব নোংরা বাঁচিয়ে। বস্তিবাসীদের মধ্যে অবাঙালিদের সংখ্যাই বেশি। কিছু বললে উল্টে ঝামেলা হত। অগত্যা ওই অবস্থাই চলে আসছিল দিনের পর দিন। এখন কিছু দিন দেখছি, জায়গাটা পরিষ্কার হয়েছে। নিয়মিত ভ্যাট সাফাই হচ্ছে। রাস্তা নোংরা করার ব্যাপারটাও অনেকটা কমেছে।
রাজবল্লভ পাড়াটা তো শ্যামবাজার ও বাগবাজারের মাঝামাঝি জায়গা। ওই দিকে শোভাবাজার। কাজেই এই অঞ্চলটার একটা পৃথক চরিত্র চিরকালই ছিল। পাড়ার মানুষ হিসেবে সেই চরিত্রের পরিবর্তনটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি। যদিও ‘পাড়া কালচার’ বলতে যেটা বোঝায়, সেই ব্যাপারটা রয়ে গিয়েছে ভীষণ ভাবেই। সকলে সকলের খবর রাখে, খুব আন্তরিক। বিপদে-আপদে প্রতিবেশীদের পাশে থাকে সকলে। গোটা একটা পরিবার যেন। যদিও একেবারে নতুন প্রজন্মরা সে ভাবে কাছে ঘেঁষে না। সময় কমছে মানুষের। তার একটা প্রভাব তো থাকবেই। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে সকলেরই সাহায্য পেয়ে এসেছি যে কোনও প্রয়োজনে। এক বার ওই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম। পুরনো বাড়ি সামলে রাখা তো মাঝে মাঝে সমস্যার হয়ে যায়, তাই। কিন্তু পাড়ার সকলে মিলে এমন করে ধরল, ‘‘দিদি আপনার কিছুতেই যাওয়া চলবে না!’’ কাজেই পাড়া ছাড়ার সিদ্ধান্তটা বদলাতেই হল।
তবে রাস্তায় গাড়ি রাখার ব্যাপারটা একটা বড় সমস্যা আমার পাড়ায়। ইদানীং অবশ্য দেখি, অনেকে ভেবে-চিন্তে গলিতে গাড়ি রাখছে। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার করে রাস্তাটা ‘ওয়ান ওয়ে’ করে দেওয়ার পরেও প্রচণ্ড যানজট হচ্ছে। আগে কিন্তু এতটা হত না! সকালে অফিসটাইমে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা হয়। রোজকার আতঙ্ক। বস্তির লোকেরা বা ফুটপাথে যাঁরা থাকেন, তাঁরা আবার ওই ডিভাইডারেই কাপড়জামা শুকোতে দেন। ওটা খুব দৃষ্টিকটু লাগে। অবশ্য ওঁরাই বা কী করবেন, কোথায়ই বা মেলবেন কাপড়!
তবুও পাড়াটা এত নিজের, এখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা আর ভাবতেই পারি না। কত স্মৃতি জড়িয়ে পাড়াটাকে ঘিরে। ওই যে বললাম, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল!
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।