—প্রতীকী চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরে ‘র্যাগিং’ শব্দটি আবার খবরের শিরোনামে। তবে, নবাগতদের অত্যাচার বা নিপীড়নের এই প্রবণতা কিন্তু বেশ পুরনো এবং তা শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ নয়। এক সময়ে নতুন নাবিকদের কম্বলে জড়িয়ে জাহাজের পাটাতনে উপর থেকে নীচে গড়িয়ে দেওয়া হত। নীচে থাকা লোকজন তাঁদের ধরে ফেলতেন। এ ভাবেই নবাগত ওই নাবিকদের জাহাজে স্বাগত জানানো হত। মনোরোগ চিকিৎসক প্রদীপ সাহা জানাচ্ছেন, আঘাত যাতে কম লাগে, তার জন্য ওই নাবিকদের ‘র্যাগ’ বা কম্বলে জড়িয়ে দেওয়া হত। ইউরোপে নাবিকদের মধ্যে নবীন বরণের এই প্রথা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রদীপের কথায়, ‘‘র্যাগ থেকেই র্যাগিং কথাটি এসেছে। যা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাধির আকার নিয়েছে।’’
যাদবপুরের ঘটনায় মেন হস্টেলে ‘সিনিয়র’ দাদাদের হাতে চরম শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল নাবালক ওই পড়ুয়া। কেন র্যাগিং করা হয়? প্রদীপের মতে, আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘‘কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের পিছনে যে মানসিকতা কাজ করে, তা হল, আমরা বড়, তাই আমাদেরই এখানে একমাত্র আধিপত্য। আমাদের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। আমরা যা বলব, জুনিয়রদের তা-ই মানতে হবে। আমাদের কথা শুনতে হবে। আমরা সিগারেট আনতে বললে, এনে দিতে হবে। কথা না শুনলে বাড়ির বড়রা যেমন শাস্তি দেন, আমরাও সে রকম শাস্তি দেব। এই মানসিকতা থেকেই র্যাগিং করা হয়।’’ র্যাগিং বন্ধ করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন প্রদীপ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া অনিমেষ দত্ত বললেন, ‘‘সমাজের সর্বস্তরেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, যদি কেউ ভিন্ন মত পোষণ করেন, অন্যদের থেকে একটু আলাদা হন, তা হলে তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা হয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কটূক্তি, পরিহাস— সবই সহ্য করতে হয় তাঁকে। মাত্রাছাড়া রকমের র্যাগিংয়ের পিছনেও এই মানসিকতা কাজ করে।’’
যাদবপুরের ক্ষেত্রেও কি ‘শিকার’-এর প্রকৃতি দেখেই তাকে বেছে নিয়েছিল ‘শিকারিরা’? যেমনটা দেখা গিয়েছিল ওয়েব সিরিজ় ‘দাহাড়’-এ। তাতে বিজয় বর্মা অভিনীত চরিত্র আনন্দ স্বর্ণকার ‘শিকার’ বাছত খুব ভেবেচিন্তে, ভাল করে কথাবার্তা বলে। যাতে অপরাধের পরে তাকে কোনও পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে না হয়। মহিলা ‘শিকার’-এর সঙ্গে যৌন সংসর্গের পরে তাঁকে খুন করত আনন্দ। মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল বললেন, ‘‘যাঁরা অপেক্ষাকৃত সরল প্রকৃতির, তাঁরা অনেক সময়েই বেশি মাত্রায় র্যাগিংয়ের শিকার হন। তাঁদের ওই সারল্যের সুযোগ নিয়েই বার বার অত্যাচার চালানো হয়।’’
পুলিশের সন্দেহ, নাবালক ওই পড়ুয়ার হেনস্থার ঘটনা মোবাইলে ভিডিয়ো করা হয়ে থাকতে পারে। সেই কারণে এই ঘটনায় ধৃতদের মোবাইল ফোনগুলি ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। সুজিত জানান, হেনস্থার ভিডিয়ো তুলে রাখার কারণেও কোনও পড়ুয়ার দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষতি হতে পারে। ভবিষ্যতে তিনি ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’-এর শিকার হতে পারেন। ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’ কাকে বলে? সুজিতের ব্যাখ্যা, ‘‘এই ঘটনা বহু বছর ধরে অত্যাচারিতকে তাড়া করতে পারে। বার বার দুঃস্বপ্নের আকারে ফিরে ফিরে আসতে পারে তা।’’