অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শোভন চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
ভোট ঘোষণা না হলেও ভোটের লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে বাংলায়। কিন্তু যুদ্ধের গোড়াতেই অস্ত্র হিসাবে কুকথা আর ব্যক্তিগত আক্রমণের যে সুর বাজতে শুরু করেছে, তা অনেকের কাছেই বেসুরো ঠেকছে। নানা দলের নানা স্তরের নেতাদের বক্তৃতায় অনেক সময়ই রাজনৈতিক বক্তব্যের বদলে প্রাধান্য পাচ্ছে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বাছাই ব্যক্তিগত বিশেষণ। গত শনিবারই দুই জেলায় রাজ্যের সামনের সারির দুই রাজনীতিকের বক্তব্য বা মন্তব্য নিয়ে একপ্রস্থ আলোড়ন হয়ে গেল। এক জন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্য জন শোভন চট্টোপাধ্যায়। একজন তাঁর প্রাক্তন দলীয় সহকর্মীকে তুই-তোকারি করলেন। একজন ‘ডাইনি’ বলে দিলেন নিজের প্রাক্তন বান্ধবীকে। এই দুটো উদাহরণ মাত্র। এঁদের বাইরেও অনেকে একই ভাবে ‘সীমা’ লঙ্ঘন করে চলেছেন ন্যূনতম সৌজন্যের।
কেন এমন হচ্ছে? কেন এমন হয়?
সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় বললেন, ‘‘প্রতিপক্ষকে আক্রমণের যুক্তি যখন হারিয়ে যায়, তখনই নেমে আসে কু-কথার বাণ।’’ সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চার শিক্ষক মানস রায়ের মতে, ‘‘গত কয়েক বছরে এটাই যেন বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপি হোক বা তৃণমূল, কু-কথায় কেউ কম যান না।’’ মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মতাদর্শের ফারাক বা রাজনৈতিক বিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু এই ধরনের কু-কথার বন্যা নিশ্চয়ই কাম্য নয়। কারণ একটা রাজনৈতিক বিরোধিতার ভাষায় এই স্তরের কু-কথার ব্যক্তি-আক্রমণ হলে জনপ্রতিনিধি হিসাবে যে মানুষদের বেছে নেওয়ার কথা ভাবছি, তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন জাগে। সংশয় তৈরি হয়।’’
বিজেপি ঘনিষ্ঠ অভিনেতা কৌশিক রায়,পার্নো মিত্র, রুদ্রনীল ঘোষই হন, কিংবা সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দেওয়া অভিনেতা ভরত কল, রনিতা দাস— ব্যক্তি আক্রমণকে কেউই ভাল চোখে দেখছেন না। তাঁদের বক্তব্য মোটের উপর এক— রাজনীতি থাকুক রাজনীতির জায়গায়। ব্যক্তিগত আক্রমণ কখনওই কাম্য নয়।
এমন নয় যে বঙ্গরাজনীতির মঞ্চ এত দিন পুরোপুরি ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ ছিল। অনিল বসু থেকে বিমান বসু, বিনয় কোঙার থেকে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসু, সোনালি গুহর মতো অনেকেই অভিযুক্ত হয়েছেন নিজেদের বাকশালীনতা লঙ্ঘনের জন্য। কিন্তু এ বারের ভোট কি অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে?
শনিবার কাঁথিতে শুভেন্দু অধিকারীর বাড়ি ‘শান্তিকুঞ্জ’-র কয়েক কিলোমিটার দূরে তৃণমূলের বিশাল সভা থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এমনিতে তো জোকারের মতো মুখ! তার উপর বড় বড় কথা! আমাকে বলছে যে, এলে দেখে নেব। বলছে যদি না শোধরাও, ওই করব, তাই করব। আরে তোর বাপকে গিয়ে বল, তোর বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি! যা করার কর! আয়!’’
ওই দিনই তৃণমূলের অভিনেত্রী বিধায়ক দেবশ্রী রায়কে ‘ডাইনি’ বলে কটাক্ষ করেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বর্তমানে বিজেপি নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়। পাশে দাঁড়িয়ে পারিবারিক কেচ্ছায় তাল মেলান শোভন-বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘বিষয়টা কী রকম জানেন, ধরা যাক আপনার গায়ে আমার থেকে বেশি জোর। তাই পেশি শক্তিতে আপনার সঙ্গে আমি পেরে উঠব না। ফলে আপনাকে আমি গালি দিলাম। ইংরাজিতে যাকে বলে ফাউল মাউথিং। অর্থাৎ মুখ খারাপ করা। যখন অন্য যুক্তিবোধ কাজ করে না, তখনই এই ভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হয়। এটা একটা দিক। অন্য দিকটি হল, যিনি মুখ খারাপ করছেন, তাঁর চরিত্র, বেড়ে ওঠা, দৈনন্দিন জীবন— এই সব কিছু তাঁর উপর ছাপ ফেলে। সবাই তো এক অবস্থায় পড়লে এক ভাবে প্রতিক্রিয়া দেন না। ফলে যাঁরা এই ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো ওই ভাষা ব্যবহারের মধ্যে কোনও খারাপ লাগা নেই। কিংবা, তাঁরা নিজেদের মধ্যে এমন ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু এটা তো দুর্বলের অস্ত্র, সবলের নয়। সবল যিনি, তিনি কম কথা বলে জোরে আঘাত করেন।’’ এর পর তাঁর সংযোজন, ‘‘এখানে আরও একটা বিষয় আছে। যাঁদের উদ্দেশে কথাগুলো বলা হচ্ছে, তাঁদের একাংশ এটা অনুমোদন করেন। ফলে এমন ভাষার মধ্যে দিয়ে একজন নেতা জনতার ওই অংশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন।’’
সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চার শিক্ষক মানস রায়ের বক্তব্য, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন বলেছিলেন, ‘আমরা ২৩৪ ওরা ৩৪’, তখন এই অসৌজন্য শহরের বামপন্থী বিদ্বজ্জনদের ভীষণ গায়ে লেগেছিল। তার পর সরকার বদল হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বহু কু-কথার বন্যা বয়ে গিয়েছে। অথচ সেই বামপন্থী বিদ্বজ্জনরা এর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি। গত ১০ বছর ধরে বাংলার রাজনৈতিক অভিজাত সমাজ যে ভাষায় কথা বলছে, তা অচিন্ত্যনীয়। এ বারও অথচ সেই বামপন্থী বিদ্বজ্জনরা কিন্তু বর্তমানে চুপ। এই বিষয়টা আমার অবাক লাগে।’’
মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ, ‘‘যে ভাষায় বর্তমানে অনেকেই কথা বলছেন, তার মধ্যে এক ধরনের অসংযম আছে। ফলে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তেমন ভাষায় কথা বললে, তা জনসাধারণের কাছে তাঁদের সম্পর্কে খুব ভাল ছবি তৈরি করে না। দ্বিতীয়ত এটা কেন হচ্ছে, তার কারণ হিসাবে বলতে হয়, ঘৃণা এবং প্রতি-ঘৃণার ভাষা প্রয়োগ করলে তার কী পরিণাম হতে পারে, সে সম্পর্কে অনেক সময় আমাদের ধারণা থাকে না। ফলে অপরিণামদর্শিতা থেকেই অনেক ক্ষেত্রে এমন ভাষা প্রয়োগ করা হয়। আঘাতের ভাষা যে আরও বেশি আঘাত ডেকে আনতে পারে, তা অনেক সময় ভাবা হয় না। সাময়িক ভাবে মনে হতে পারে, আমি বাগ্যুদ্ধে হয়তো জিতে গেলাম। কিন্তু সাময়িক বাগ্যুদ্ধে জয় জনমানসে আমার কী রকম প্রতিচ্ছবি তৈরি করে, তা ভাবা হয় না। রাজনীতিবিদদের এই বিষয়টায় একটু সজাগ থাকার প্রয়োজন আছে।’’
অভিনেতা, বিজেপি রাজনীতিক কৌশিক রায় বলছেন, ‘‘দু’টি বিষয়েই আমার বক্তব্য পরিষ্কার। রাজনীতি থাকবে রাজনীতিতেই। রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গা থেকে লড়াইটা হলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনে হয় এঁদের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলার নেই। তাই ব্যক্তিগত আক্রমণের দিকে এগোচ্ছেন।’’ গেরুয়া শিবির-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী পার্নো মিত্র-র বক্তব্য, ‘‘এ রকম রাজনৈতিক বিষয়ে হুট করে মন্তব্য করতেই চাই না। কোন পরিপ্রেক্ষিতে কী ঘটনা ঘটছে,তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় এ সব ক্ষেত্রে। তবু আমি বলব, কোনও পরিপ্রেক্ষিতেই এক জন মহিলাকে ডাইনি বলা যায় না। এই ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়।’’
তৃণমূল শিবিরের অভিনেত্রী রনিতা দাসের বক্তব্য, ‘‘নির্বাচনের আগে লোভ দেখিয়ে দলবদল করানো হচ্ছে, যে যার ডেরায় ঢুকে অন্য দলের মানুষকে হুমকি দিয়ে চলেছে। আর এর ফলে একে অপরের প্রতি রাগ ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। তবে আমার মতামত, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে সৌজন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক চর্চা হোক।’’
সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দেওয়া অভিনেতা ভরত কলের মত, ‘‘রাজনীতি থাকুক রাজনীতির জায়গায়। কিন্তু এ রকম ভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণকে মেনে নিতে পারব না আমি।’’
সদ্য বিজেপি-তে যোগ দেওয়া অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ যোগ করছেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে শুভেন্দু অধিকারীকে তুই-তোকারি করেছেন, তা নিন্দনীয়। এই ধরনের মন্তব্য সচেনতন ও শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে আশা করা যায় না। উনি যেহেতু নিজেকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দাবি করেন, তাই তাঁর মুখে এ সব কথা মানায় না। অন্য দিকে, দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী চট্টোপাধ্যায়ের যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। পেশার জায়গায় আলাদা করে এঁরা পরিচিত। কিন্তু আদপে তো তাঁরা ব্যক্তি-মানুষ। সেখান থেকেই এই দ্বন্দ্বের শুরু বলে আমার ধারণা। এগুলো আসলে তাঁদের বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের বিষয়। তাতেও আমি মনে করি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ ধরনের মন্তব্য করার সময়ে যতটা সম্ভব নিজেকে ঠান্ডা রাখাটা জরুরি।’’