সুপ্রিম কোর্টে মিথ্যে অভিযোগ থেকে কলঙ্কমুক্ত হয়ে বেরোলেও সন্তানদের কাছে আজও ফেরা হয়নি এক তরুণীর। প্রতীকী ছবি।
একটা সময়ে তাঁর মনে হত, এ যেন বার বার অগ্নিশুদ্ধির মধ্যে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা। ২০০০ সালের ৪ জুন দুপুরে দুই কোলের সন্তানকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকার সময়ে পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল সদ্য স্বামীহারা এক তরুণীকে। মুনমুন বসু ওরফে অপরাজিতার জীবন তখনই পাল্টে যায়। দীর্ঘ ১৩ বছর কারান্তরালে কাটিয়ে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে মিথ্যে অভিযোগ থেকে কলঙ্কমুক্ত হয়ে বেরোলেও সন্তানদের কাছে আজও ফেরা হয়নি তাঁর। উল্টে নানাখেসারত দিয়ে সন্তানদের মন পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন মুনমুন। এখন, ২৩ বছর বাদে দেওয়ালে পিঠ ঠেকা সঙ্কটে নিজের ছেলেদের কাছ থেকে প্রাপ্য পারিবারিক সম্পত্তিরঅধিকার পেতে পুলিশের দ্বারস্থ সেই মা। দুই সন্তান ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে লেক থানায় বিশ্বাসভঙ্গ এবং জুলুম, হুমকি ও মানসিকনির্যাতনের অভিযোগ দায়েরকরেছেন মুনমুন। এত বছর বাদে সম্প্রতি আবার পুলিশের সঙ্গে নিজের শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছেন তিনি। তবে মুনমুনের দাবিমাফিক তাঁর প্রাপ্য স্ত্রীধন এখনও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
২০০০ সালে কোনও রকম সরাসরি বা পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই স্বামীকে খুনের অভিযোগে কারান্তরালে যেতে হয়েছিল মুনমুনকে। তাঁর স্বামী কুণালকে এক বন্ধু নান্টু রায় খুন করে বলে জেনেছিল পুলিশ। কিন্তু কুণালের মা মুনমুনের দিকেও অভিযোগের আঙুল তোলেন। ২০০৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতে সাজা হয় মুনমুনের।
অনেক পরে ন্যায়বিচারের জন্য কলকাতা হাই কোর্টে মামলা লড়তে নামেন আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। ২০১৩-র এপ্রিলে প্রথম বার জামিনে জেল থেকে বেরোন মুনমুন। সেই বছরের ডিসেম্বরে হাই কোর্টে বেকসুর খালাস পান তিনি। মুনমুনের শাশুড়ি তার পরেও সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৪-র মে মাসে হাই কোর্টের রায়ই বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। মুনমুনের কথায়, “তখনও বুঝিনি, সন্তানদের কাছ থেকে কোন আঘাত অপেক্ষা করছে। শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতে না-পারলেও সন্তানদের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে আমার শ্বশুরবাড়ির প্রোমোটিংয়ের জন্য ওদের আমার সম্মতি দরকার ছিল। আমার পাওয়া ১৩ লক্ষ টাকার বড় অংশ খরচ করেছিলাম ছেলেদের নানা দাবি মেটাতে, বাঁশদ্রোণীতেআমার স্বামীর নামে ফ্ল্যাট মেরামতির কাজে। ভেবেছিলাম, এ ভাবেই ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগবে। এখন আমার টাকা ফুরিয়েছে। ছেলেরা শুধুই অপমান করছে।”
মুনমুনের দুই পুত্রই এখন যুবক। চাকরিরত। বড় ছেলে অভ্রনীল বসু বলেন, “আমার মা যা অভিযোগ করেছেন, সে-বিষয়ে পরে কথা বলব।” এর পরে তাঁকে বা তাঁর ছোট ভাই, কাউকেই ফোনে পাওয়া যায়নি।
৫৪ বছরের মুনমুন এখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন। সামান্য মাইনে পান। বাড়িতে অসুস্থ মা। ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশায়। তিনি বলছেন, “আমার স্বামীর নামে ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারি না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় স্বামীর চাকরির পিএফ, গ্র্যাচুইটির টাকা— কিচ্ছু পাইনি। মা-বাবার দেওয়া গয়নারও হদিস নেই।” স্থানীয় পুলিশের বক্তব্য, “মুনমুনের অভিযোগ মতো ওঁর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খোঁজ করেছিলাম। আইন মেনে যা করার, করা হবে।”
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণের কথায়, “জেলের বন্দিদের অনেকেই পরিবারের মধ্যে বঞ্চনার শিকার। হতেই পারে, মুনমুনের সন্তানদের কেউ মাকে নিয়ে ভুল বুঝিয়েছে। কিন্তু সন্তানদেরও মায়ের প্রতি কিছু কর্তব্য থাকে। মুনমুনের অধিকার ফেরাতে যা করার করা হবে।” শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি আলমারি নিয়ে এলেও সন্তানদের জন্য তাঁর মা-বাবার থেকে পাওয়া উপহার সোনার চেনে হাত দিতে পারেননি মুনমুন। রুদ্ধ স্বরে বলছেন, “জীবনভর লড়েছি। অধিকারের লড়াইটা সাধ্য মতো এর পরেও চালিয়ে যাব।”