প্রতীকী ছবি।
এখন মরলেও বিপদ!
নোটে নাজেহাল এই দেশে প্রিয়জন হারানোর শোকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে চূড়ান্ত ভোগান্তি, লড়াইও। বাবার মৃত্যুর পরে গত পনেরো দিন ধরে যে লড়াইটা লড়তে হল আমাকে।
বিয়েবাড়ির কার্ড দেখালে এককালীন আড়াই লক্ষ টাকা তোলার সুযোগ দিয়েছে মোদী সরকার। কিন্তু শ্রাদ্ধানুষ্ঠান! সেখানে কোনও সুবিধা নেই। সেখানে পিতৃহীন আমাকে আর পাঁচজনের সঙ্গে দাঁড়াতে হল একই লাইনে। বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা পাশে সরিয়ে রেখে, দিশেহারা মায়ের কথা ভুলে, সাড়ে চার বছরের ছেলেকে ফেলে আমি আর স্বামী বারবার সেই টাকার লাইনেই ছুটলাম এ ক’দিন— সকাল, বিকেল, সন্ধে। এমনকী রাত বারোটাতেও।
আমি দমদম স্টেশনের কাছে থাকি। আমার বাবা মাধবচন্দ্র ভট্টাচার্য। বয়স সত্তর ছুঁলেও সুস্থ ছিলেন।
কিন্তু গত ২১ নভেম্বর ভোরে ‘সেরিব্র্যাল অ্যাটাক’। সে দিনই ডাক্তারবাবুরা জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মন তৈরি ছিল না। ২৩ তারিখ সকালে হাসপাতাল থেকে ফোনে এল বিপর্যয়ের খবরটা— বাবা আর নেই।
এর পরে যে কী, ভাবতে পারছিলাম না। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। জানতাম আমাকেই সব সামলাতে হবে। কিন্তু জানতাম না নোটের চোটে পরিস্থিতি কতটা সঙ্গিন! বাড়িতে আত্মীয়দের ফিসফাসে কানে আসছিল শব্দগুলো। শ্মশান, দাহ, শ্রাদ্ধ, দান, কার্ড...। গম্ভীর পরিবেশেও টাকা নিয়ে টুকটাক আলোচনাও কানে আসছিল।
কার্ডে কেনাকাটায় আমি রপ্ত, স্বচ্ছন্দও। হাসপাতালের টাকা কার্ডেই মিটে গেল। কিন্তু তারপর প্রতি পদে হোঁচট। শববাহী গাড়ি থেকে শ্মশান— সবাই নগদ চাইল। বাড়িতে যে ক’টা টাকা ছিল নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তার মধ্যে কয়েকটা দু’হাজারি নোট। সে টাকা দিতেই শুনতে হল, ‘‘মাফ করবেন দিদি, ভাঙিয়ে দিতে পারব না।’’ পাশের দোকানে ছুটলাম খুচরোর খোঁজে।
বাবাকে দাহ করে বাড়ি ফিরে মন যখন তোলপাড়, মায়ের চোখের জল বাঁধ ভাঙছে না, আমার একরত্তি ছেলেটা বারবার প্রশ্ন করছে, ‘‘দাদুভাইকে কোথায় রেখে এলে’— সে সব আমার মগজে ঢুকল না। কানে তখন শুধু বাজছে ‘ভাঙিয়ে দিতে পারব না’। ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলাম শ্রাদ্ধ, নিয়মভঙ্গ পর্যন্ত সব আয়োজন সুষ্ঠু ভাবে করতে আরও অনেক অনেক একশো-পাঁচশোর নোট চাই।
পরদিন থেকে শুরু হল সেই নোট জোগাড়ের লড়াই। সকাল দশটাতেই আমার স্বামী ব্যাঙ্কে ছুটলেন। কিন্তু সেখানে তখন প্রায় একশো জনের লাইন। এ দিকে বাড়িভাড়া, পুরোহিত, কেটারার, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের যাবতীয় উপকরণ কেনাকাটা, নিমন্ত্রণ— সব তো আমাদের দু’জনকেই করতে হবে। তাই ঠিক করলাম, ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে যাতায়াতের পথে এটিএম থেকে যেমন যেমন পারব টাকা তুলব। নিকট পরিজনদের বলেকয়ে একাধিক অ্যাকাউন্টের ডেবিট কার্ড জোগাড় হল। তারপর থেকে দু’সপ্তাহ ধরে রোজ বারবার এটিএমের লাইনে দাঁড়ানোটা যেন নিয়ম হয়ে গেল।
এ ক’দিন প্রায় রোজই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আমি আর আমার স্বামী সন্দীপন ঘোষাল। নানা কাজ সারার ফাঁকে নিয়ম করে খুঁজে বেড়াতাম এমন এটিএম যাতে টাকা আছে। আমাদের বাড়ি দমদম স্টেশনের কাছে। ব্যস্ত এলাকা। নানা ব্যাঙ্কের এটিএমও নেহাত কম নয়। কিন্তু গত দু’সপ্তাহে দেখেছি বেশিরভাগেরই ঝাঁপ বন্ধ অথবা দরজায় ঝোলানো ‘নো ক্যাশ’ বোর্ড। কোনও এটিএমের ঝাঁপ অর্ধেক নামানো দেখলে ছুটে গিয়েছি। নিরাপত্তারক্ষীর কাছে জানতে চেয়েছি, ‘‘কী দাদা, মেশিনে টাকা ভরা হচ্ছে নাকি?’’ মাথা নেড়ে ‘না’ জানিয়ে দিয়েছেন বন্দুকধারী। আবার শুরু হয়েছে আমাদের খোঁজ।
আমার অনেক বন্ধুবান্ধবই ‘ক্যাশলেস’ লেনদেনের পক্ষে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পরে রাস্তায় নেমে দেখলাম, কাঠের দোকানদার বলছেন, ‘নগদ আনুন’। দশকর্মা ভাণ্ডার খুচরো চাইছে। পাড়ার মিষ্টির দোকান, কলেজ স্ট্রিটের কার্ডের দোকানেও এক ছবি। রবীন্দ্র-কবিতা ছিল বাবার আশ্রয়। শ্রাদ্ধের ‘দানে’ সঞ্চয়িতা দেওয়ার ইচ্ছেটা তাই ছিল। সেটা কিনতে গিয়েও শুনতে হল, ‘‘বইপাড়ায় কার্ড-ফার্ড চালু হয়নি এখনও।’’ পুরসভার কমিউনিটি হল ভাড়াও গুনতে হয়েছে নগদে।
একটা সময় মনে হচ্ছিল কাজটা ঠিকমতো মিটবে তো! শেষে পরিচিত কেটারার চেকে টাকা নেওয়ায় কিছুটা সুরাহা হয়েছে। শ্রাদ্ধ, নিয়মভঙ্গ মিটে গিয়েছে ভালয় ভালয়।
তবে লড়াই কিন্তু থামেনি। এখন মাসের শুরু। পরিচারিকা থেকে ছেলের স্কুলের গাড়ি, পাড়ার মুদি দোকান— সব টাকাই তো মেটাতে হবে নগদে। আর রোজকার সব্জি, মাছ তো রয়েইছে।
আমার মা মঞ্জু ভট্টাচার্য এমন এক মহিলা, যিনি দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ পেলেও ভেঙে পড়েন। কিন্তু তিন দশকেরও বেশি সময়ের জীবনসঙ্গী হারানো সেই মানুষটিও এখন শোক চেপে রেখে টাকার চিন্তা করছেন। অফিস বেরনোর মুখে বৃহস্পতিবারও আমাকে বললেন, ‘‘ব্যাঙ্কের কার্ডটা নিয়েছিস তো? পারলে একটু টাকা তুলে নিস।’’