নার্স কেয়া পালের সঙ্গে আজ্জান বিবি ও তাঁর স্বামী মোক্তার। পাভলভে, শনিবার। —নিজস্ব চিত্র
ওয়ার্ডের দু’টো তলায় তিরিশ-তিরিশ জনা ষাটেক মহিলা আবাসিক। তাঁদের দেখাশোনার দায়িত্বে সাকুল্যে চার জন নার্স। হাসপাতালের উপরে-নীচে দু’জন করে দায়িত্ব ভাগাভাগি। এক সঙ্গে এত জনের পরিচর্যার চাপে হিমশিম খেতে হয়। সরকারি হাসপাতালের ২৬ বছরের পুরনো স্বাস্থ্যসেবিকা কেয়া পাল তবু চেষ্টায় ফাঁক রাখেননি। ঘরহীন আবাসিকদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতাই ক্যানিংয়ের আজ্জান বিবির পুনর্বাসনের দরজা খুলে দিল।
শনিবার পাভলভ হাসপাতালের সকালটা তার জন্যই অন্য রকম হয়ে ওঠে। দীর্ঘ দু’বছর আট মাস বাদে আজ্জান বিবি এবং তাঁর স্বামী মোক্তার আলি লস্করের দেখা হওয়ার মুহূর্তটা অনেক নার্সদের চোখেই বাঁধিয়ে রাখার মতো মুহূর্ত। কেয়া পাল রবিবার বলছিলেন, “আমি দেখি, গরাদের ও পারে বৌকে দেখে ভদ্রলোকের (মোক্তার) চোখে জল! আজ্জানেরও চোখ চিকচিক করছে।”
এই আবেগঘন ছবির পিছনের ঘটনাবলিও চমকপ্রদ। ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পাভলভে ছিলেন আজ্জান। পুলিশ হাওড়ার গ্রামীণ এলাকা থেকে তাঁকে ‘উদ্ধার’ করে পাভলভে ভর্তি করায়। অপ্রকৃতিস্থ দশা থেকে সেরে ওঠার পরেই ‘বাড়ি, বাড়ি’ করে আকুল হয়ে ওঠেন আজ্জান। কিন্তু কোথায় বাড়ি? জিজ্ঞাসা করলে মুখে শুধু দু’-তিনটে শব্দ— ‘কলপাড়া’, ‘লস্করপাড়া’, বরের নাম ‘মোক্তার’। ব্যস! কেয়া বলছিলেন, “আমি শব্দগুলো মেয়েটার (আজ্জান) টিকিটে লিখে রাখছিলাম! এটা বুঝি যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার দিকটার কথাই বলছে!” এই সূত্রটুকুর ভিত্তিতেই ওয়ার্ডের অন্য একটি মেয়ের স্বামীকে খোঁজ নিতে বলেন কেয়া। তিনি আবার ফেরিওয়ালা। তাঁকে আজ্জানের একটি ছবিও দিয়েছিলেন কেয়া। পাভলভ সূত্রের খবর, ওই ব্যক্তি মারফতই আজ্জানের স্বামী তাঁর স্ত্রীর খবর পান। এবং স্ত্রীর ছবি হাতে সটান হাজির হন হাসপাতালে।
মোক্তার হাসপাতালে জানিয়েছেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার সময়ে স্ত্রী হারিয়ে যান। এর আগেও কয়েক বার রাস্তা হারিয়েছেন তিনি। এত দিন নানা ভাবে স্ত্রীকে খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন মোক্তার। মধ্য চল্লিশের আজ্জানও বলেছেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা! কী করে হাওড়ায় গেলেন, তা অবশ্য বলতে পারেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে শনিবারই আজ্জানকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝবয়সি দম্পতির আবেগ দেখে কেয়া বলছেন, “কত বার আবাসিকদের স্বামীকে ফোন করলে গালমন্দ শুনতে হয়, তাঁরা ফোন কেটে দেন। কিন্তু এমনও তো ঘটে।” হাসপাতালের তরফে পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হবে বলে জানাচ্ছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার সেবন্তী মুখোপাধ্যায়।
ডাক্তারেরা বার বার বলেন, মনোরোগীদের শতকরা ৯০ ভাগই ওষুধে সুস্থ থাকেন, বাড়ি থেকে কাজটাজও করতে পারেন। কিন্তু এক বার মানসিক হাসপাতালে গেলে পরিবারই ফিরে নিতে চায় না। ২৫০ শয্যার পাভলভে তাই অন্তত ৬৭০-৮০ জন ভর্তি থাকেন। সমাজকল্যাণ দফতরের প্রত্যয় জীবন সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমেও এই সুস্থ আবাসিকদের স্বনির্ভর করে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। সুস্থ আবাসিকদের বাড়ি ফেরাতে মানসিক হাসপাতাল এবং প্রত্যয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও অনেক দিন কাজ করে চলেছে। পাভলভের সুপার মৃগাঙ্কমৌলী করের কথায়, “আমাদের সিস্টার দিদিরা কাজের চাপের মধ্যেও আবাসিকদের ভাল রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেন, কেয়ার কাজে তা বোঝা গেল। মেয়েটির স্বামীও ভাল মানুষ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে! ওঁরা ভাল থাকুন।”