Durga Puja 2024

‘ছেলেটাই শুধু নেই’, পুজোয় আলোহীন অঙ্গীকারের মা-বাবা

গত ১৮ জুলাই সল্টলেকের সিএ স্কুলের পড়ুয়া, দমদম থানা এলাকার মল রোডের বাসিন্দা অঙ্গীকার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। হলদিরাম বাসস্টপে বাস থেকে নামার সময়ে পড়ে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তার।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৪৯
Share:

অঙ্গীকার দাশগুপ্তের ছবির সামনে তার মা-বাবা। মঙ্গলবার, মল রোডের বাড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।

মল রোডের ফ্ল্যাট থেকে প্রতিদিন রাজারহাটের স্কুলে যেতে হয় ইংরেজির শিক্ষিকাকে। আর প্রতিদিনই সে সময়ে নিদারুণ যন্ত্রণা গ্রাস করে তাঁকে। কারণ, ভিআইপি রোডের হলদিরাম বাসস্টপের পাশ দিয়েই স্কুলে যান তিনি। কয়েক মাস আগে এই বাসস্টপই কেড়ে নিয়েছে তাঁর সন্তান, একাদশ শ্রেণির অঙ্গীকার দাশগুপ্তের (১৬) প্রাণ। তার মা কস্তুরী দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আমায় যে কত বড় শাস্তি পেতে হয় প্রতিদিন! রোজ ওই জায়গাটা দিয়েই স্কুলে যেতে হয়। পিছনে ঘুরে দেখতে পাই, বাসগুলো আবার রেষারেষি করছে। কেন তখন পুলিশ ব্যবস্থা নেয় না? বুকটা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। মনে হয়, আমার মতো কোনও মায়ের কোল আবার ফাঁকা হয়ে যাবে না তো?”

Advertisement

গত ১৮ জুলাই সল্টলেকের সিএ স্কুলের পড়ুয়া, দমদম থানা এলাকার মল রোডের বাসিন্দা অঙ্গীকার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। হলদিরাম বাসস্টপে বাস থেকে নামার সময়ে পড়ে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তার। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বারাসতমুখী এল-২৩৮ এবং ৭৯ডি বাসের মধ্যে রেষারেষি চলছিল সে দিন। বাসস্টপের কাছে এসে জোরে ব্রেক কষায় চলন্ত এল-২৩৮ থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হয় অঙ্গীকার। প্রথমে কাছাকাছি একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। পরে পাঠানো হয় বারাসত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। খবর পেয়ে অঙ্গীকারের মা-বাবা যতক্ষণে সেখানে গিয়ে পৌঁছন, ততক্ষণে সব শেষ।

মল রোডে দুই কামরার ফ্ল্যাটের দক্ষিণমুখী বারান্দা সংলগ্ন ঘরটাই ছিল অঙ্গীকারের। সেই ঘরের টেবিল থেকে আলমারি, সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে তার প্রিয় বইগুলি— হ্যারি পটার, শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, বিভূতিভূষণ থেকে ফেলুদা সমগ্র। সে দিকে তাকিয়ে কস্তুরী বলে চলেন, “বইগুলো আছে, বইয়ের তাক, চেয়ার-টেবিল সব আছে। ওর লেখা অসমাপ্ত স্ক্রিপ্ট আছে। ছেলে একাদশ শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই ইংরেজি সংবাদপত্রে ফিচার লিখত। সেই সব লেখাও রয়ে গিয়েছে টেবিলে। ছেলেটাই শুধু নেই। নিজেকে খুব অসহায় লাগে। এ বার পুজোয় আমার বাড়িতে আর আলো জ্বলবে না। হয়তো আর কোনও পুজোতেই জ্বলবে না।’’

Advertisement

হুগলির একটি কলেজে ইংরেজির শিক্ষক অঙ্গীকারের বাবা অঞ্জন দাশগুপ্ত। তাঁর প্রশ্ন, “ছেলের মৃত্যু ঘিরে এখনও বহু প্রশ্নের উত্তর পাইনি। ঘটনার পরেই কেন আমাদের জানানো হল না? একেবারে নিয়ে যাওয়া হল বারাসত হাসপাতালে। ছেলের গলায় স্কুলের পরিচয়পত্র ঝুলছিল। সেখানে আমাদের ফোন নম্বর ছিল। কেন সঙ্গে সঙ্গে ফোন করা হল না? ওর মৃত্যু ঘটনাস্থলেই হয়েছে, না কি বারাসত হাসপাতালে, সেটাও পরিষ্কার জানি না। পুলিশ কেন আমাদের না জানিয়ে বারাসত হাসপাতালে নিয়ে গেল? আগে জানতে পারলে আমরা কলকাতার অন্য কোনও হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারতাম। বাস থেকে নামার সময়ে কন্ডাক্টর ওকে পাদানিতে নেমে দাঁড়াতে জোর করেছিল। হঠাৎ ব্রেক কষায় ছেলে টাল সামলাতে পারেনি। ওদের কি কোনও শাস্তি হবে না? এখনও পর্যন্ত পুলিশ চার্জশিট জমা দেয়নি বলেই জানি। ছেলের বিচার না পেয়ে পুজোয় উৎসবে ফেরার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’’

টেবিলে রাখা ছেলের ছবিটা আঁকড়ে ধরেন কস্তুরী। কান্নাভেজা গলায় বলেন, “পুজোর দিনে ওর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। ভোরে উঠে পড়ত রেডিয়োয় মহালয়া শুনতে। গত বারও শুনেছে। ওর সব মুখস্থ ছিল। রেডিয়োর মহিষাসুরমর্দিনীতে কারা কারা গান করেছেন, কে সুর দিয়েছেন, সব ওর মুখস্থ ছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উপরে নানা বই পড়ে তাঁর সম্পর্কে রীতিমতো গবেষণা করেছিল। আমি ছেলেকে বলতাম, তুই আমার গুগ্‌ল। আমি কিছু জানতে চাইলে ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করতাম।’’ কিন্তু পুজোর সময়ে কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইত না অঙ্গীকার। বলত, ‘‘মা, কলকাতার পুজো দেখতে কত লোক বাইরে থেকে আসে। আর আমরা কেন পুজোয় বাইরে বেড়াতে যাব?’’

“পুজো চলে এল। ছেলের এ সব কথাই মনে পড়ছে। পুজোর সময়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।’’— আনমনে বলে চলেন ছেলেহারানো মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement