—প্রতীকী চিত্র।
রাতের শহরে যেখানে সিগন্যাল না-মেনেই গাড়ি বা মোটরবাইক ছোটান অনেকে, সেখানে নিয়ম মেনে সিগন্যালে দাঁড় করানো গাড়িতেই প্রাণ গেল বিয়েবাড়ি-ফেরত একই পরিবারের তিন জনের! তবে কি বিধি মেনে সিগন্যালে দাঁড়িয়েও রক্ষা নেই? এ ভাবে একাধিক মৃত্যুর ঘটনার পরেও কেন পুলিশ-প্রশাসনের হুঁশ ফিরছে না?
মঙ্গলবার এই সমস্ত প্রশ্নই তুললেন নিউ আলিপুরের বাসিন্দা দেবকিষাণ ঢনঢনিয়া। মানিকতলার পরিবারের মতো গত জুন মাসে একই ভাবে বেলেঘাটা বিল্ডিং মোড়ের সিগন্যালে তাঁদের দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে পিছন থেকে ধাক্কা মারে দ্রুত গতিতে আসা একটি বিলাসবহুল গাড়ি। সিগন্যাল ভেঙে এমন ভাবে সেটি ধাক্কা মারে যে, দেবকিষাণদের গাড়ি সামনে দাঁড়ানো একটি লরির পিছনে সজোরে গিয়ে লাগে। গাড়িচালক, নিজের দুই সন্তান এবং দেবকিষাণ কোনও মতে বেঁচে গেলেও মারা যান তাঁর স্ত্রী মিনু। বেশ কয়েক মাস হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফেরেন বছর একান্নর দেবকিষাণ। এ দিন তিনি বললেন, ‘‘মানিকতলার ঘটনায় স্বামী, সন্তান এবং শাশুড়িকে হারানো মহিলা অন্য গাড়িতে থাকায় বেঁচে গিয়েছেন শুনেছি। এর পরে তাঁর মনের অবস্থা কী হতে পারে, বুঝি। ওই রাতে আমার সঙ্গেও তো একই ব্যাপার ঘটেছে। তার পরেও কিন্তু রাতের কলকাতার চিত্রটা কিছু মাত্র বদলায়নি।’’
নাগরিকদের বড় অংশেরই অভিযোগ, রাতের শহরে সিগন্যাল মানার বালাই থাকে না অনেক জায়গাতেই। কেউ সিগন্যাল ভেঙে গাড়ি ছোটান নেশার তাড়নায়, কেউ বেপরোয়া হাবভাব থেকেই সিগন্যাল মানার কথা মাথায় রাখেন না। যেখানে পুলিশের নাকা-তল্লাশি চলে, সেখানে কিছুটা সতর্কতা দেখা গেলেও বাকি শহর থেকে যায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত। কলকাতা পুলিশেরই হিসাব বলছে, চলতি বছরের গত ছ’মাসে এমন সব চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ইএম বাইপাস এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে। কলকাতা পুলিশ এলাকায় না হলেও এর পরেই রয়েছে ভিআইপি রোড। ট্র্যাফিক পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ ভাবে সিগন্যালের সামনে গত ছ’মাসে দুশোটিরও বেশি দুর্ঘটনার রিপোর্ট নথিভুক্ত হয়েছে। যার ৯০ শতাংশই রাতের কলকাতায় ঘটেছে। সিগন্যালের সামনে মৃত্যুর সংখ্যা পনেরোর কাছাকাছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের তরফে আলাদা করে সমস্যা খতিয়েও দেখা হয়েছে। তাতে সামনে এসেছে, কোনও সিগন্যালেই কোনও সমস্যা ছিল না। পথ-নির্দেশিকা বোঝার জটিলতা থাকারও কোনও ব্যাপার নেই। তা সত্ত্বেও এমন ঘটনা ঘটে গিয়েছে নেশার ঘোরে কিংবা বেপরোয়া ভাবে। বেশ কয়েকটি এমন উদাহরণও মিলেছে, যেখানে দুর্ঘটনার কারণ ছিল অপরাধ করে পালানোর চেষ্টা।
এ শহরের বাসিন্দা গাড়িচালকদের একাংশ আবার জানাচ্ছেন অন্য একটি সমস্যার কথা। তাঁদের দাবি, অনেকেই পথ-নির্দেশিকা বুঝতে ভুল করেন। গাড়িচালকদের বড় অংশেরই ধারণা নেই, শহরের কোনটি একমুখী রাস্তা এবং কত ক্ষণ ধরে সেটি একমুখী থাকে। পুলিশ সূত্রের খবর, সৌমেন মিত্র নগরপাল থাকাকালীন ২০২১ সালে সর্বশেষ একমুখী রাস্তা সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়। তার ভিত্তিতে শহরে এই মুহূর্তে ২২৫টি একমুখী রাস্তা রয়েছে। যার মধ্যে বড় অংশই ২৪ ঘণ্টা একমুখী থাকে। কিছু রাস্তা রবিবার ছাড়া অন্য কাজের দিনে রাত ৯টার পরে দ্বিমুখী করে দেওয়া হয়। কিছু রাস্তা দ্বিমুখী হয় রাত ২টোর পরে। কিন্তু এই সংক্রান্ত ধারণা না থাকায় অনেকেই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি নিয়ে ভুল রাস্তায় ঢুকে বিপদে পড়েন। পুলিশের লাগানো ক্যামেরায় ধরা পড়লে জরিমানা হয়। তাতেও কি হুঁশ হয়?
কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের যুগ্ম-নগরপাল পদমর্যাদার এক পুলিশ আধিকারিক বললেন, ‘‘সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ির আক্রান্ত হওয়া নিয়ে কিছু একটা করতেই হবে। এই সমস্ত ঘটনায় কড়া হাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ (পার্ট-২) যুক্ত করতে হবে। যার অর্থ, অনিচ্ছাকৃত খুন। কিন্তু এটা অভিযুক্ত জানতেন যে, ওই ভাবে গাড়ি চালিয়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং প্রাণহানি হতে পারে। কড়া শাস্তি ছাড়া বেপরোয়া ভাব কমবে না।’’