মহিলাদের এই সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। —প্রতীকী চিত্র।
চিত্র ১: বার বার জ্বর আসছিল প্রবীণার। ওষুধ খেয়ে কমে গেলেও দিন কয়েক পরে ফিরে আসছিল জ্বর। বেশ কিছু দিন পরে ধরা পড়ে, মূত্রনালির সংক্রমণ হয়েছে তাঁর।চিত্র ২: মূত্রনালির সংক্রমণের জেরে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল এক প্রৌঢ়াকে। টানা কয়েক দিন আইসিইউ-তে রেখে চিকিৎসা করতে হয় তাঁর।
দু’ক্ষেত্রেই পরিজনেরা অবাক হয়েছিলেন। কারণ ওই প্রবীণা বা প্রৌঢ়া কেউই বাড়ির বাইরে কোথাও শৌচাগার ব্যবহার করেননি। বাড়িতেও পরিচ্ছন্নতার অভাব নেই। তা হলে তাঁদের মূত্রনালির সংক্রমণ (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই) হল কী ভাবে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, গলদ রয়েছে এই ভাবনাতেই। এই সংক্রমণের কারণ বাড়ির বাইরের শৌচাগার বা অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহার নয়। কারণ নিজের দেহে থাকা ব্যাক্টিরিয়াই। মানুষের পাচনতন্ত্রে, বিশেষত বৃহদন্ত্রে থাকা ই কোলাই এবং আরও কয়েকটি ব্যাক্টিরিয়া থেকে মূলত ইউটিআই হয়। পায়ু থেকে কোনও ভাবে তা মূত্রনালিতে পৌঁছে গেলেই ঘটে বিপত্তি। তাই মহিলাদের এই সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
শারীরিক গঠনগত কারণে মহিলাদের পায়ু ও মূত্রনালির মধ্যে দূরত্ব কম, মূত্রনালির দৈর্ঘ্যও কম বলে জানাচ্ছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসক চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। এর জেরে সহজেই পায়ু থেকে মূত্রনালিতে ব্যাক্টিরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। আবার নালি পথে ব্যাক্টিরিয়া পৌঁছে যেতে পারে মূত্রথলিতে। কিডনি পর্যন্ত ব্যাক্টিরিয়া পৌঁছে গেলে তার জেরে হতে পারে তীব্র সংক্রমণ। কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য বৃহদন্ত্রে অনেক বেশি ব্যাক্টিরিয়া জমে গেলে বাড়ে সংক্রমণের আশঙ্কা। বাড়ির বাইরে শৌচাগার ব্যবহারে অসুবিধা থাকায় মহিলাদের মধ্যে প্রস্রাব চেপে রাখা ও জল কম খাওয়ার প্রবণতা বেশি। এই দুই কারণও ডেকে আনে ইউটিআই। পাশাপাশি, মেনোপজ়ের পরে দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যাওয়াও বাড়িয়ে দেয় সংক্রমণের ভয়। তাই মহিলাদের মধ্যেও প্রৌঢ়া ও প্রবীণাদের ইউটিআই বেশি হয়। এ ছাড়া, লিঙ্গ নির্বিশেষে ডায়াবিটিস বা ক্যানসার রোগী, অন্য কোনও কারণে প্রতিরোধ ক্ষমতা যাঁদের কম, তাঁদের ক্ষেত্রে ইউটিআই-এর আশঙ্কা বেশি। বয়সজনিত কারণে মূত্রথলি স্থানচ্যুত হলে, ক্যাথিটার ব্যবহার করতে হলে সংক্রমণের ভয় বাড়ে। পুরুষদের জন্য প্রস্টেটের সমস্যা থেকেও ইউটিআই দেখা দিতে পারে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, মূত্রনালির সংক্রমণের অন্যতম লক্ষণগুলি হল— প্রস্রাবে জ্বালা ও ব্যথা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়া, ঘোলাটে ও দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব, বার বার মূত্রত্যাগ, জ্বর, কাঁপুনি, পেটে-পিঠের নীচের দিকে ব্যথা ইত্যাদি। পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গে ব্যথাও হতে পারে। এ ছাড়া, বয়স্কদের মধ্যে সেপসিস ও বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে এই সংক্রমণ। কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণ থাকলেও তার উপসর্গ থাকে না। সে ক্ষেত্রে মূত্র পরীক্ষায় ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতি পেলেও ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার দরকার পড়ে না। যাঁদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের অবশ্য উপসর্গ না থাকলেও চিকিৎসা দরকার। না হলে বেড়ে যেতে পারে সংক্রমণ। গর্ভাবস্থায় উপসর্গহীন সংক্রমণ নিয়ে বিশেষ ভাবে সতর্ক করছেন চিকিৎসকেরা। সে ক্ষেত্রে দ্রুত ঠিক চিকিৎসা একান্ত প্রয়োজনীয়, তা না হলে সময়ের আগে সন্তানের জন্মের আশঙ্কা থাকে।
ইউটিআইয়ের চিকিৎসায় যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে সতর্ক করছেন ইউরোলজিস্ট বিভাস কুণ্ডু। তিনি জানান, এই রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহারের প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। বিনা প্রয়োজনে ওই ওষুধ খেলে দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে। তাঁর পরামর্শ, উপসর্গ ছাড়া পরীক্ষায় ব্যাক্টিরিয়ার উপস্থিতি ধরা পড়লে অন্য ভাবে তা স্বাভাবিক করায় জোর দিতে হবে। যেমন, বেশি করে জল পান, ক্র্যানবেরির রস বা ট্যাবলেট খাওয়া ইত্যাদি। মেনোপজ়ের পরে ইস্ট্রোজেন ট্যাবলেট বা ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শও দিতে পারেন চিকিৎসক। এক বার সংক্রমণের পরে তা ফিরে আসার আশঙ্কা বাড়ে। তবে জীবনযাত্রায় সাধারণ কয়েকটি বিষয় মানলেই সেই আশঙ্কা কমানো সম্ভব, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।