প্রতীকী চিত্র।
ছোঁয়াচ বাঁচানো মানে কি অস্পৃশ্যতা? তার মানেই কি আপনকে পর করতে হয়? তখন কি বেঁচে থাকে শুধু স্বার্থ? এত দিন ধরে কোভিড-দেহ ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রশ্নগুলো মাথায় আসে আজকাল।
অস্পৃশ্যতা— শব্দটার সঙ্গে আমার পরিচয় জ্ঞান হওয়া ইস্তক। আমার বাবা ডোম। সাত বছর বয়সে মুখ তুলে সেই পরিচয় দিয়েছিলাম। আজও বলি, আমি ডোম, আমার চার পুরুষ ডোম। সমাজের অস্পৃশ্যতা নিয়ে টিপ্পনী যে ছেলে গায়ে মাখেনি, সে কোভিডকে ভয় পাবে?
এই সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে বুঝেছি, বাবা-মায়ের ছাতা সরে গেলে যে ভয় ঘিরে ধরে, তার থেকে ভয়ানক এই দুনিয়ায় কিছু নেই। ছয় ভাই-বোনের সবার ছোট আমি। খেলাধুলো ভালবাসতাম। যা দেখে বাবার স্বপ্ন ছিল, আমাকে পুলিশ হতে দেখবেন। হইনি। কারণ, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম আর কলেজ পেরোনোর আগেই বাবাকে। আমরা আদতে বিহারের বাসিন্দা। ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। স্ত্রী থাকত ওর মা-বাবার কাছে। বাবার মৃত্যুর পরে আমি একা হয়ে গেলাম। হাতে টাকা নেই। বৌকে আনলাম দেশ থেকে। পড়া ছেড়ে এ দিক-ও দিক কাজের খোঁজ করে বাবার জুতোয় পা গলিয়েছিলাম বছর ১৪ আগে। পরিবার নিয়ে এখন বাবা-মায়ের শেষ আস্তানা আঁকড়ে আছি। আর আঁকড়ে আছি বাবার সেই স্বপ্নটাকে।
২০১১ সাল। এসএসকেএমে ডোম হিসেবে কাজ করছি তখন। ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে একের পর এক দেহ ঢুকছিল। চাপ বাড়ছিল ময়না-তদন্তে। সেই কাজে সাহায্য করতে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে পেয়ে গেলাম এই দায়িত্ব। এটা ঠিক, এই পেশায় আসার পরিকল্পনা ছিল না। তাই ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু এসেই যখন পড়েছিলাম, লজ্জা বা ভয় পাইনি। এখন যেটুকু ভয় বেঁচে রয়েছে, সবটাই দুই ছেলে-মেয়েকে ঘিরে। আমার দুটো স্বপ্ন আছে। একটা নিজের স্বপ্ন, আর একটা বাবার অধরা স্বপ্ন। দশম শ্রেণিতে পড়ে মেয়েটা। ওর গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলতে দেখতে চাই। আর চাই, ছেলেটা পুলিশ হোক।
স্বপ্নগুলো যাতে বেঁচে থাকে, তাই রোজ লড়াই করছি। অথচ যখন দেখি, একটা ভাইরাসের ভয়ে কেউ কেউ বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী বা ভাই-বোনের পরিচয়কে স্বপ্নে ভাবতেও পিছিয়ে যান, খুব লজ্জা হয়। ঘৃণা হয়। এ কোন সমাজ? দূর থেকে কোনও রকমে দেহ শনাক্ত করে ‘হ্যাঁ, এটা আমার’, বলেই দায় সারেন অনেকে। তাঁদের পরের লক্ষ্য শুধুই ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করা।
তবে এর উল্টো দিকও রয়েছে। সাম্প্রতিক একটা ঘটনা মনে পড়ছে। এক বৃদ্ধ ভর্তি হয়েছিলেন সাধারণ চিকিৎসার জন্য। অস্ত্রোপচার জরুরি ছিল। তাই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগেই অস্ত্রোপচার করেন ডাক্তারবাবুরা। ওঁর মাঝবয়সি মেয়ে কিন্তু বাবার খোঁজ করতে এমন কঠিন সময়েও হাসপাতালে রোজ আসতেন। সিস্টার দিদিদের থেকেই শোনা। রিপোর্ট আসার পর পরই মারা যান বৃদ্ধ। মেয়ে ছুটে এসে শিশুর মতো কাঁদছিলেন। এত বছর ধরে মানুষ দেখছি, কোন কষ্ট ভিতর থেকে আসছে, চিনতে ভুল হয় না।
কোভিডের সঙ্গে সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছেন অসংখ্য মানুষ। চিকিৎসকেরা বলে দেবেন চিকিৎসার পদ্ধতি। আর বাকিরা দেবেন তাঁদের পরামর্শ। আর আমরা? মৃতদেহ নিয়ে কাজ করাই যাঁদের পেশা। তাই অনুরোধ করব, মানবিকতা হারাবেন না। পরিবারের মানুষটি, যিনি এত কাল জুড়ে ছিলেন আপনার সঙ্গে, সবার আগে তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দিন। ভয় করুন রোগকে, রোগীকে নয়।
(লেখক একজন ডোম)