জ্বলছে বাসটি। —নিজস্ব চিত্র।
কখনও হাওড়া সেতুর উপরে ব্যস্ত সময়ে চলন্ত গাড়িতে আগুন ধরে যাচ্ছে। কখনও আগুন ধরছে ভিআইপি রোড ধরে যাওয়া বিয়েবাড়ির গাড়িতে। দিন সাতেক আগে চাঁদনি চক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে এমন ভাবে আগুন লাগে, যার জেরে পুড়ে যায় আশপাশে দাঁড়ানো বেশ কয়েকটি গাড়িও। বৃহস্পতিবার একই ভাবে আগুন লেগেছে একটি যাত্রিবোঝাই চলন্ত বাসে! তাতে কোনও মতে রক্ষা পেয়েছেন যাত্রীরা। একের পর এক এমন ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, এমন ভাবে গাড়ি, বাসে আগুন ধরে যাওয়ার কারণ কী? তীব্র গরমেই কি এমনটা ঘটছে?
এ দিন কলকাতা ট্রাম কোম্পানির একটি চলন্ত বাসে আগুন লাগে। সি-৭ রুটের ওই বাসটি গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজ থেকে রামনগর, সেন্ট্রাল গার্ডেনরিচ রোড হয়ে হাওড়া যায়। বাস সংস্থার তরফে মনে করা হচ্ছে, প্রবল গরমেই সেটিতে আগুন ধরে গিয়েছিল। ওই বাসের কন্ডাক্টর জিতেন্দ্রকুমার সিংহের দাবি, সকাল ৯টা ৪০ মিনিট নাগাদ হেস্টিংস মোড়ের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ বাস থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা যায়। মুহূর্তে ইঞ্জিনের দিক থেকে আগুন বেরোতে শুরু করে। তাঁর কথায়, ‘‘তখন বাসের মধ্যে ৩০ জনেরও বেশি যাত্রী ছিলেন। বেশ কিছু বাচ্চাও ছিল। ধোঁয়ায় এমন দমবন্ধ পরিস্থিতি হয় যে, সকলে কাশতে শুরু করেন। কোনও মতে তাঁদের নামিয়ে এনে বাসটা ফাঁকা করা গিয়েছে।’’ এর পরে দমকলের একটি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশের দাবি, এই ঘটনায় কেউ আহত হননি। কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। যদিও এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কী ভাবে একের পর এক গাড়িতে আগুন লাগার বিপদ এড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। মধ্য কলকাতার একটি স্কুলের সামনে এক শঙ্কিত অভিভাবক আবার বললেন, ‘‘আমার বাচ্চার স্কুলবাসে এমন ঘটনা ঘটলে কী হত!’’
গাড়ি বিক্রির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থায় কাজ করেন, এমন অনেকেই বলছেন, গত কয়েক দিনের তীব্র গরমের কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। এই সময়ে, বিশেষ করে পেট্রলচালিত গাড়িতে কোনও ভাবেই ট্যাঙ্ক ভর্তি করে জ্বালানি ভরা উচিত নয় বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, ট্যাঙ্ক ভর্তি করে জ্বালানি ভরলে বাষ্প থাকার জায়গা কমে যায়। অথচ, তীব্র গরমে ট্যাঙ্কে বেশি বাষ্প (ভেপার) তৈরি হওয়ার ফলে যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে। পাশাপাশি, গাড়ির ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণের উপরেও বিশেষ নজর দেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা।
উত্তর কলকাতার একটি গাড়ি বিপণির দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক সৌরভ গুহ বললেন, ‘‘নিয়মিত সার্ভিসিং করানো অত্যন্ত জরুরি। কুলেন্ট, ইঞ্জিন অয়েলের মাত্রা ঠিক আছে কি না, নিয়মিত দেখা দরকার। বহু ক্ষেত্রেই গাড়ির কোনও তার ছেঁড়া থাকতে পারে। সেটা যাতে নজর এড়িয়ে গিয়ে গরমে আগুন ধরে যাওয়ার মতো ঘটনা না ঘটাতে পারে, সে দিকে নজর দিতে হবে।’’ নিউ টাউনের আর একটি গাড়ি বিপণি সংস্থার কর্মী তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘অতিরিক্ত গরমে সরাসরি ইঞ্জিনে আগুন লেগে যাবে, ব্যাপারটা এমন নয়। তবে, ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে ইঞ্জিন অয়েল, ট্রান্সমিশন ফ্লুইড লিক করে ইঞ্জিনের আশপাশে থাকা প্লাস্টিকের সংস্পর্শে এলে আগুন ধরার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া, ইঞ্জিনের ‘হেড গ্যাসকেট’ ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ওভারহিটেড বা অতিরিক্ত গরম হওয়ার কারণে নষ্ট হতে পারে। ফলে নাগাড়ে গাড়ি না চালিয়ে বরং যানকে বিশ্রাম দিতে হবে।’’
কিন্তু যেখানে একাধিক দুর্ঘটনার পরেও রক্ষণাবেক্ষণে জোর না দিয়ে ‘রিসোল’ টায়ারে একাধিক গণপরিবহণ চালিয়ে যাওয়া হয়, নিরাপত্তার কথা মাথায় না রেখে এবং গাড়ি বা চালককে বিশ্রাম না দিয়েই রাত-দিন অ্যাপ-ক্যাব চালানো হয়, সেখানে এই সচেতনতা আদৌ দেখা যাবে কি— সেই প্রশ্ন তুলছেন ভুক্তভোগীরা।