ফাইল ছবি
প্রায় দু’দশক আগে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ও পরিবেশমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন রাজ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। সেই চিঠিতে টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাঁরা। একই সঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে এটাও বলেছিলেন, একেই টালি নালার মৃতপ্রায় অবস্থা। টালি নালা সংস্কারে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তার কোনওটাই বাস্তবায়িত হয়নি। তার উপরে যদি প্রস্তাবিত মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের জন্য তার উপরে ৩০০টি স্তম্ভ তৈরি হয়, তা হলে একে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই সম্প্রসারণের বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হোক।
ইতিহাস বলছে, বিশিষ্টজনেদের সেই আর্জিতে কোনও কাজ হয়নি। অবশ্য কাজ যে হবে না, তার ইঙ্গিত আগেই পাওয়া গিয়েছিল, যখন টালি নালা সংস্কারের জন্য ১৯৯৬ সালে ‘ন্যাশনাল রিভার কনজার্ভেশন ডিরেক্টরেট’ ও তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে যথাক্রমে ২৯ কোটি এবং ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এবং যে সংস্কারের কাজকে দেড় বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু সেই নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। নির্দেশ বাস্তবায়নের পরিবর্তে তখনও যা হত, এখনও তাই-ই হচ্ছে। সংস্কারের নামে শুধু পলি নিষ্কাশন ও আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ হচ্ছে।
দু’দশক আগে ওই চিঠি-লেখকদের একজন, পরিবেশবিদ মোহিত রায় জানাচ্ছেন, সরকারি দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই টালি নালার বর্তমান দুরবস্থার অন্যতম কারণ। তাঁর কথায়, ‘‘বছর ২০ আগেই রাজ্য সরকারের তরফে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছিল, হেস্টিংস থেকে টালি নালা জলপথ পরিবহণের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হবে। আবার তারাই সে সময়ে মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের জন্য সেখানে স্তম্ভ তোলার অনুমোদন দিয়েছিল। ফলে এটা সরকারি ব্যর্থতা ছাড়া আর কী?’’ মেট্রো রেলের প্রস্তাবিত স্তম্ভ তৈরি নীতির বিরুদ্ধে ২০০১ সালে আবার কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। সুভাষবাবুর পাল্টা হলফনামা দাখিল করে মেট্রো রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও। মেট্রোর তরফে বলা হয়, টালি নালার মাঝ বরাবর স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পরেই। এবং এই প্রকল্প করা হচ্ছে বৃহত্তর কলকাতাবাসীর সুবিধার্থে। তাছাড়া এই সম্প্রসারণের ফলে পরিবেশগত কী প্রভাব পড়ছে, তার জন্য ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ও করা হবে।
দু’পক্ষের কথা শোনার পরে হাইকোর্ট রায়ে জানায়, যেহেতু পরিবেশ-সুরক্ষা আইন, ১৯৮৬-এর পরে ভারতীয় রেলওয়ে আইন, ১৯৮৯ কার্যকর হয়েছে, তাই এক্ষেত্রে রেলওয়ে আইনই প্রযোজ্য হবে। তা ছাড়া রেলওয়ে আইনের ১১ নম্বর ধারার প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়, এই ধারা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে কোনও জমি, রাস্তা, নদী, খাল-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো যে কোনও নির্মাণ তোলার ক্ষমতা দিয়েছে। সুভাষবাবুর কথায়, ‘‘কোনও বিষয় নিয়ে দু’টি আইনের মধ্যে সংঘাত হলে যে আইনটি পরে কার্যকর হয়েছে, সেটিই গ্রাহ্য হয়। এ ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছিল। কিন্তু তার ফলে মৃতপ্রায় টালি নালার কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে যায়।’’
ফলস্বরূপ এক দিকে টালি নালার উপরে স্তম্ভ ওঠায় তার প্রবাহ থমকে গিয়েছে। ক্রমশ আবর্জনার স্তূপে দমবন্ধ অবস্থা টালি নালার। অন্য দিকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টালি নালার পাড় বরাবর লোকসংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১ সালে যেখানে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা ছিল ৩৬,৩৩০ জন, সেখানে ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭,০৪৬ জনে। সামগ্রিক কলকাতা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই অঞ্চলেরও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানী তপন সাহা বলছেন, ‘‘শহর যখন দক্ষিণের দিকে প্রসারিত হয়, তখন নিকাশি নালাগুলির অভিমুখ টালি নালার দিকে ছিল। তার পরে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা তৈরি শুরু হলে সেই অভিমুখের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল বটে। কিন্তু তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়।’’
যার ফল— বছর চারেক আগে জাতীয় পরিবেশ আদালত টালি নালার জলের দূষণের পরিমাপ করার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে। একই সঙ্গে যে ৫৭টি নিকাশি নালা যা টালি নালায় পড়ে এবং যার মাধ্যমে সরাসরি দূষিত জল গঙ্গায় গিয়ে মেশে, তার উপরে সমীক্ষা করতে বলেছিল।
ওই দূষিত জলের পরিমাণ কত? পরিবেশবিজ্ঞানীরা কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একটি রিপোর্টের উল্লেখ করে যে তথ্য দিচ্ছেন, তাতে চমকে উঠতে হবে— দৈনিক প্রায় ৩৮ কোটি ২ লক্ষ লিটার!
(চলবে)