বিপজ্জনক: সকালের দুর্ঘটনার পরেও বাইপাসে চলছে অতিরিক্ত মালবোঝাই এমন লরি। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
ধারণ-ক্ষমতা দেড় হাজার কেজি। কিন্তু ছুটছে দু’হাজার কেজি টাইলস নিয়ে! যার জেরে মঙ্গলবার সকালে ই এম বাইপাসে বড়সড় দুর্ঘটনায় পড়ল একটি লরি! চাকা খুলে বেরিয়ে যাওয়ায় হুড়মুড়িয়ে উল্টে গেল সেটি। স্তূপীকৃত টাইলসের উপরে বসে থাকা বেশ কয়েক জন লরি থেকে ছিটকে পড়লেন রাস্তায়। মৃত্যু হল তাঁদের মধ্যে তিন জনের। আহত মোট ন’জন। তবে, কোনও মতে রক্ষা পেয়েছেন চালক। এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, একের পর এক এমন কাণ্ড ঘটলেও মালবাহী গাড়ির অতিরিক্ত ভার বহন বন্ধ হয় না কেন? কেনই বা শহরের রাস্তায় এ ভাবে অতিরিক্ত ভার নিয়ে ছুটতে থাকা লরি পুলিশের নজরে পড়ল না?
পুলিশ জানিয়েছে, লরিটি চালাচ্ছিলেন ধ্রুবমঙ্গল দাস নামে এক যুবক। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, কোনও মতে নজরদারির ফাঁক গলেই উল্টোডাঙা থেকে বাইপাস ধরে মাঠপুকুরের কাছে পৌঁছেছিল লরিটি। উল্টোডাঙার একটি গুদাম থেকে সেটিতে টাইলস বোঝাই করা হয়েছিল। ওই পণ্য যাচ্ছিল কালিকাপুরের কাছে একটি গুদামে। মাঝরাস্তায় ঘটে বিপত্তি। পুলিশের অনুমান, অতিরিক্ত ভারের কারণেই লরিটির পিছনের দিকের একটি চাকা খুলে বেরিয়ে যায়।
পুলিশি সূত্রে জানা গিয়েছে, লরিটি যখন প্রগতি ময়দান থানা এলাকার মাঠপুকুরের কাছে পৌঁছয়, তখন গতি ভালই ছিল। চাকা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও লরি বেশ কিছুটা চলে। কিন্তু অতিরিক্ত ভার বোঝাই থাকার কারণে সেটি এর পরে এক দিকে উল্টে যায়। ভিতরে চালক-সহ ন’জন ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ওই টাইলসের গুদামের কর্মী। লরি উল্টে যেতেই তাঁরা ছিটকে রাস্তায় পড়েন। স্তূপীকৃত টাইলস ভেঙে তাঁদের কয়েক জনের উপরে পড়ে। পিছনের কয়েকটি গাড়ির চালক কোনও মতে গতি নিয়ন্ত্রণ করেন। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যান ট্র্যাফিক পুলিশের কর্মীরা। আট জনকে উদ্ধার করে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হয়। এর জেরে এক সময়ে ই এম বাইপাসে তীব্র যানজট তৈরি হয়। পরে পুলিশ টাইলস এবং দুর্ঘটনাগ্রস্ত লরিটি সরিয়ে গাড়ির চাপ হালকা করে।
পুলিশ জানায়, লরিতে থাকা প্রত্যেকেরই বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার উচিলদহ গ্রামে। তাঁদের মধ্যে শম্ভুনাথ দাস (৬২), প্রণব বেরা (৩২) ও বাপ্পা হালদার (২৯) নামে তিন জনের অবস্থা সঙ্কটজনক ছিল। দুপুরের পরে এসএসকেএম হাসপাতালেই তিন জনের মৃত্যু হয়। অভী দাস নামে আর এক যুবকের অবস্থাও সঙ্কটজনক। তিনি এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারে চিকিৎসাধীন। অন্য চার জনকে অবশ্য চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারের সামনে গিয়ে দেখা গেল, স্বজনহারাদের মধ্যে শোকের ছায়া। রাজেশ দাস নামে এক যুবক কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘একই দিনে বাবা আর মামাকে হারালাম। আমাদের আর কেউ রইল না!’’
এই ধরনের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ম বদল করে জানায়, একটি ট্রাক বা লরি ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত ওজন নিতে পারে। যাকে ‘সেফ অ্যাক্সেল লোড’ বলা হয়। কিন্তু সর্বভারতীয় এই বিধি প্রথমে এ রাজ্যে মানা হচ্ছিল না। রাজ্যের নিয়ম ছিল, ট্রাক তার বহন-ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য তুলবে, অতিরিক্ত ভার নিতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছিল, তিন-চার গুণ বেশি ওজন নিয়ে লরি এবং মালবাহী গাড়িগুলি শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য কেন্দ্রের নিয়ম চালু করে। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। অতঃপর জানিয়ে দেওয়া হয়, মাত্রাতিরিক্ত ভার বহন করলে প্রথম বার ২০ হাজার টাকা জরিমানা এবং প্রতি টন ‘ওভারলোডিং’-এর জন্য দু’হাজার টাকা করে অতিরিক্ত জরিমানা নেওয়া হবে। দ্বিতীয় বার অপরাধের ক্ষেত্রে জরিমানা দ্বিগুণ করার এবং তৃতীয় বার অপরাধের ক্ষেত্রে পারমিট বাতিলের যে সংস্থান রয়েছে কেন্দ্রের আইনে, তা-ও করা হবে। কিন্তু তার পরেও লরি বা মালবাহী গাড়ির দাপট যে বন্ধ হয়নি, তা এ দিন ফের প্রমাণিত হল বলে অনেকের দাবি।