—প্রতীকী চিত্র।
ইডেনে ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচে বিপক্ষের শেষ উইকেট পড়ার পরেই শুরু হয়েছিল মাঠের বাইরে শব্দবাজির ‘তাণ্ডব’। যার জেরে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল ঘোড়সওয়ার পুলিশের একটি ঘোড়ার। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই ঘোড়সওয়ার পুলিশকর্মীও। তাঁদের মধ্যে এক জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। জখম দু’জন দর্শকও।
পুলিশ সূত্রের খবর, ম্যাচ শেষ হতেই ক্লাব হাউসের উল্টো দিকে পলাশি গেট রোডে ফাটানো হয় দেদার শব্দবাজি। কিছু ক্ষণ ধরে নাগাড়ে প্রবল শব্দে ফাটতে থাকে সেই সব বাজি। যার জেরে পুলিশের ঘোড়াগুলি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মৃত ঘোড়াটির দেহের ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা গিয়েছে, আতঙ্কে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয় বছর পাঁচেকের ‘ভয়েস অব রিজ়নস’। খেলা চলাকালীন ইডেনের বাইরে ঘোড়াগুলির কাছাকাছি ছিলেন কলকাতা পুলিশের পশু চিকিৎসক সুরজিৎ বসু। তিনি ওই রাতে মৃত ঘোড়াটির দেহের ময়না তদন্তও করেন। সুরজিতের কথায়, ‘‘পলাশি গেট রোডে ছ’জন ঘোড়সওয়ার পুলিশ ছিলেন। খেলা শেষ হতেই তীব্র আওয়াজ ও আলোর ঝলকানিতে ঘোড়াগুলি ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করে।’’ তিনি জানান, দর্শক ও পুলিশকর্মীদের আঘাত করে তিনটি ঘোড়া একাধিক গাড়ি ও মোটরবাইকের উপরে উঠে পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘সব থেকে বেশি আহত ঘোড়াটিকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে সেটির মৃত্যু হয়।’’ পুলিশ জানিয়েছে, আরও তিনটি ঘোড়া আহত হয়। একটি ঘোড়ার পেটে সেলাই হয়েছে। তিনটি ঘোড়ার চিকিৎসা চলছে। ঘোড়াগুলির আঘাতে পুলিশকর্মী, দর্শকেরাও জখম হন।
এই ঘটনায় পুলিশের অনুমতি ছাড়াই ইডেনের বাইরে সিএবি কর্তৃপক্ষ দেদার শব্দবাজি ফাটিয়েছেন বলে অভিযোগ। যদিও সিএবি-র পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও সরব হয়েছেন পশুপ্রেমী ও পরিবেশকর্মীরা। তাঁদের সাফ কথা, ‘‘ইডেনের বাইরে বেআইনি ভাবে শব্দবাজি ফাটানোয় সিএবি দোষী হলে পুলিশ দ্বিগুণ দোষী। চোখের সামনে শব্দবাজি ফাটলেও পুলিশ কেন তা বন্ধ করল না?’’ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘আমরা সিএবি-কে বাজি ফাটানোর কোনও অনুমতি দিইনি। ওদের কাছে কেবল লিখিত ভাবে কলকাতা পুলিশের অনুমতি নিয়ে শর্তসাপেক্ষে সবুজ বাজি ফাটানোর আবেদন জানিয়েছিলাম। সিএবি ওই ভাবে শব্দবাজি ফাটিয়ে অন্যায় করেছে।’’ লালবাজারের দাবি, ‘‘রবিবার রাতে সবুজ বাজি ফাটানোর অনুমতি সিএবি নিয়েছিল। তবে, ইডেনের বাইরে সবুজ বাজি ফাটানো হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ এ বিষয়ে সিএবি-র প্রেসিডেন্ট স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়কে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। টেক্সট মেসেজেরও উত্তর দেননি। সিএবি সচিব নরেশ ওঝার অবশ্য দাবি, ‘‘আতশবাজি ফাটানোর অনুমতি আমাদের কাছে ছিল। দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত অনুমতিও ছিল। আইপিএলের সময়েও এই ধরনের বাজি আমরা ফাটিয়ে থাকি।’’
পুলিশের একাংশের বক্তব্য, ঘোড়সওয়ার বাহিনী ইডেনের বাইরে পার্কিং লটে ডিউটি করছিল। সেখানে যে বাজি ফাটানো হবে, তা তারা জানত না। ফলে, ওই এলাকায় বাজি মজুত হয়েছে কি না, তা-ও জানা ছিল না। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘ম্যাচ চলাকালীন পার্কিং করা গাড়ির পাশে বাজি মজুত হচ্ছে দেখে এক দর্শক লালবাজার কন্ট্রোল রুমে বিষয়টি জানান। এর পরেই লালবাজার থেকে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের জানানো হলে কিছু গাড়ি সরানো হয়।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, তার মধ্যেই ম্যাচ শেষে হয়ে গেলে বাজি ফাটানো শুরু হয়। পুলিশের ওই অংশ বলছে, ‘‘বাজিগুলি বিকট শব্দে নীচে ফাটার পরে আকাশে উঠছিল। তাতে দিশাহারা হয়ে যায় ঘোড়সওয়ার বাহিনীর ঘোড়াগুলি। বাজির ফুলকিও এসে তাদের গায়ে পড়তে থাকে। তাতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ঘোড়াগুলি।’’ একাধিক পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘‘বাজি যে বাইরে পার্কিং লটে ফাটানো হবে, তা নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল না।’’
দুর্ঘটনার পরে সরব হয়েছে একাধিক পশুপ্রেমী সংগঠন। তারা প্রশ্ন তুলেছে, শব্দবাজির তাণ্ডবের এই ঘটনার পরে পুলিশ কেন এখনও সিএবি-র বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল না? পশুপ্রেমী দেবশ্রী রায় বলেন, ‘‘সাময়িক আনন্দের জন্য সিএবি যে কাণ্ডটা ঘটাল, তাতে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের পদক্ষেপ করার কথা। পুলিশ থাকলেও তারা কেন বাজি ফাটানো বন্ধ করল না?’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তেরও প্রশ্ন, ‘‘পুলিশের সামনে বাজি ফাটানো হলেও তারা কেন আটকাল না?’’ কলকাতার নগরপাল বিনীত গোয়েল ও যুগ্ম নগরপাল (সদর) সন্তোষ পাণ্ডেকে একাধিক বার ফোন ও মেসেজ করা হলেও জবাব মেলেনি। সিএবি-র প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ তথা কলকাতা পুরসভার পুরপ্রতিনিধি বিশ্বরূপ দে অবশ্য অভিযোগ করছেন, ‘‘আমি সিএবিতে থাকাকালীন ইডেনের খেলায় শব্দহীন বাজি ফাটানো হয়েছিল। রবিবার রাতে সমস্ত নিয়মই লঙ্ঘন হয়েছে।’’