—প্রতীকী ছবি।
লম্বায় ৫৬ ফুট এবং চওড়ায় ৮ ফুট। ওজন কয়েকশো কিলোগ্রাম। কাঁচামাল বলতে পাঁচ কাহন খড়, ৫০টি বাঁশ আর ৩০ বান্ডিল হোগলা পাতা। নিজেদের হাতে তৈরি এমনই নৌকা ‘শিউলি’-কে নিয়ে এ বার জলে নামবেন ১১ জন অভিযাত্রী। লক্ষ্য, মাত্র আট দিনে বহরমপুর থেকে গঙ্গাপথে কলকাতার উট্রামঘাটে এসে পৌঁছনো। আর নিজেদের অ্যাডভেঞ্চারের ঝুলিতে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে এই নৌকা অভিযানে শামিল হচ্ছেন দুই বাঙালি পর্বতারোহী— রুদ্রপ্রসাদ হালদার এবং সত্যরূপ সিদ্ধান্ত।
জলপথে এমন অভিযান অবশ্য নতুন নয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমুদ্র পথে ইউরোপ থেকে ভারতে এসেছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা। ১৯৪৭ সালে কাঠের ভেলায় ভর করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছতে প্রশান্ত মহাসাগরে ভেসে পড়ার সেই বিখ্যাত ‘কন-টিকি’ অভিযানই হোক, বা ১৯৫৯ সালে সমুদ্র অভিযাত্রী পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের মাত্র ১৮ ফুটের ডিঙি নিয়ে বিপদসঙ্কুল বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে আন্দামানে পৌঁছনো— জলের অভিযানের এমন ইতিহাস রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। পিনাকীরঞ্জনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০১৩ সালে ২৭ ফুটের নৌকা নিয়ে ১৮ দিনে আন্দামান পৌঁছেছিল আরও একটি বাঙালি অভিযাত্রী দল। সেই দলেরই তিন সদস্য— তাপস চৌধুরী (২০০৬ সালে তেনজিং নোরগে অ্যাডভেঞ্চার সম্মানপ্রাপ্ত), পুষ্পেন সামন্ত এবং অসীম মণ্ডল রয়েছেন এ বারের এই খড়ের নৌকা অভিযানে। আর তাঁদের সঙ্গে জলে ভাসতে চলেছেন দুই ‘মাউন্টেন ম্যান’ সত্যরূপ এবং রুদ্রপ্রসাদও।
আরও পড়ুন: বহুমূল্যের গয়না লোপাটের চেষ্টায় ধৃত যুবক
কেন এই অভিযান? মূল উদ্যোক্তা পুষ্পেন জানাচ্ছেন, এর আগে পাটকাঠি, প্লাস্টিকের বোতল, হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি নৌকা নিয়ে গঙ্গায় ভেসে পড়ার সাহস দেখিয়েছেন তিনি। এ বার তাঁদের লক্ষ্য— বহরমপুর থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার জলপথ খড়ের নৌকায় ভর করে পাড়ি দেওয়া। আগামী ৩ ডিসেম্বর বহরমপুরের
একটি ঘাট থেকে শুরু হয়ে যে অভিযান শেষ হবে আগামী ১১ ডিসেম্বর, উট্রামঘাটের ‘দ্য সি এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউট’-এর সামনে। টানা আট দিন, ভাটার সময়ে আট জন অভিযাত্রী সমানে দাঁড় টেনে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাবেন গন্তব্যের দিকে। থাকা-খাওয়া, রান্নাবান্না— সবই হবে মাঝগঙ্গায়, নৌকার মধ্যেই! পুষ্পেনের দাবি, ‘‘খড়ের নৌকা যাতে বেশি ভারি না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখছি। খড় দিয়ে নৌকা তৈরি করে জলে নামা সম্ভবত এই প্রথম।’’
তবে শুধু জলে ভেসে থাকাই নয়, সচেতনতার প্রচারের কাজও চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক অভিযাত্রীরা। রুদ্রপ্রসাদের কথায়, ‘‘গঙ্গার কোথায় কোথায়
বেশি দূষণ হচ্ছে, তার একটা ম্যাপিং করার চেষ্টা করা হবে। সেই সঙ্গে কোভিড নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কখনও কোনও ঘাটে নৌকা দাঁড় করিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে প্রচারও চালানো হবে।’’
ইতিমধ্যেই আট জন অভিযাত্রী বহরমপুর পৌঁছে সেখানে নৌকা বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন। হাতে রয়েছে কয়েকটা মাত্র দিন। তার মধ্যেই বানিয়ে ফেলতে হবে সেটি। অভিযান শেষে সেই নৌকা যাতে গঙ্গাদূষণের কারণ না হয়, সে দিকেও খেয়াল রেখেছেন অভিযাত্রীরা। পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব ভাবে তৈরি এই নৌকা যাতে জলে থেকে পচে না যায়, সে জন্য কলকাতার কোনও একটি সার তৈরির কারখানায় সেটি দিয়ে দেওয়া হবে বলে জানাচ্ছেন এভারেস্ট-কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করে ফেরা রুদ্রপ্রসাদ।
কিন্তু পাহাড় ছেড়ে হঠাৎ জলে-খড়ির ইচ্ছে কেন দুই পর্বতারোহীর? বর্তমানে নেপাল হিমালয়ের আমা দাবলাম শৃঙ্গ অভিযানে যাওয়া, সপ্তশৃঙ্গজয়ী সত্যরূপের মেসেজে উত্তর— ‘নিজেকে শুধু পাহাড়ের গণ্ডির মধ্যেই আটকে রাখতে চাই না। জঙ্গল হোক বা মরুভূমি, জল হোক বা পাহাড়— অ্যাডভেঞ্চারের সব দিকই চেখে দেখতে চাই’।