মনীষা: বাঁ দিক থেকে নিখিল সরকার, রমাপদ চৌধুরী, সুধীর মৈত্র ও ক্ষিতীশ সরকার। মার্চ ১৯৬৩। ছবি: হিমানীশ গোস্বামী।
আনন্দবাজার পরিচালক নির্বাচনে, পরিচালনারীতিতে, মতপ্রচারে ও ব্যক্তিগত আচরণে যে নব্যতা দেখাইতেছে, উহার উদ্ভব ‘আনন্দবাজারেই’ হইতেছে না।
উহা আসিতেছে এই যুগের বাঙালি সমাজ হইতে, অন্ততপক্ষে সমগ্র বাঙালি সমাজের যে-ভাগে এখনও কিছু প্রাণ
আছে সেই অংশ হইতে। ‘আনন্দবাজার’ উহার প্রচারক মাত্র, উহাও হইয়াছে সংবাদপত্রটির কর্তৃপক্ষ স্ত্রী-পুরুষে নব্য বাঙালি সমাজভুক্ত বলিয়া।”
কথাগুলি লিখেছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ১৯৯৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত সাত দশক নামাঙ্কিত বিশেষ সঙ্কলনে। তার পর বাইশ বছর অতিক্রান্ত। আর এক বছর পরেই ‘আনন্দ-শতক’। এখন মনে হয়, নীরদচন্দ্রের পর্যবেক্ষণ তখনও ছিল নিখুঁত এবং তা আজও বহাল আছে। যে ‘নব্যতা’ আনন্দবাজার পত্রিকার ছত্রে ছত্রে আজও বিদ্যমান, তা কিন্তু কখনওই একই রকম ছিল না, এবং এখনও তা নিত্য বিবর্তিত হচ্ছে। তবে তার উৎসভূমি সর্বকালেই, নীরদচন্দ্রের ভাষায়, ‘সমগ্র বাঙালি সমাজের যে-ভাগে এখনও কিছু প্রাণ আছে সেই অংশ হইতে।’
এক সময় ছিল— এবং যে সময় আজ বহু দিন যাবৎ হারিয়ে গিয়েছে উপরের ‘লফ্ট’-এ নিক্ষিপ্ত অনেক কিছুর মতো— যখন বাঙালি সমাজের ‘প্রাণ’ ধুকপুক করত তার অসম্ভব সাহিত্যপ্রীতির ভিতর দিয়ে। সেটি সত্তরের দশকের কথা। সেই সময়েই এই লেখকের পরিচয় আনন্দবাজার ভবনের সঙ্গে। তবে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে নয়, সেই গোষ্ঠীরই ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’-এর সঙ্গে। আমার মনের মধ্যে তখনও বাংলা সাহিত্য বাসা বাঁধেনি এবং তার বিশেষ সম্ভাবনাও ছিল না, কারণ ডাক্তারি পড়ার মাঝদরিয়ায় হঠাৎ শেক্সপিয়রের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ইংরেজি অনার্সে নাম লিখিয়েছিলাম, মা-বাবার বদান্যতার সুযোগ নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে নমস্কার বিনিময়ের সম্পর্ক থাকলেও তখনও সেই সখ্য গড়ে ওঠেনি, যা কিছু গল্প উপন্যাস ও তাদের চরিত্রদের করে তোলে মানুষের আজীবন সঙ্গী।
অফিসে প্রথম হাজিরার দিন থেকেই শুনলাম, এটিই বাংলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর। সত্যই তা-ই। সিঁড়ি দিয়ে যিনি নেমে যাচ্ছেন তিনিই নাকি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বাংলা ছোটগল্পের এক প্রধান কারিগর, যাঁকে তখনও চিনতাম শুধু সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ফিল্মের কাহিনিকার হিসেবে। আবার আমাদের নিউজ় ডেস্ক থেকে অনতিদূরে একটি ছোট টেবিলে বসতেন এক মুখচোরা ভদ্রলোক, যাঁর সঙ্গে সহসা দৃষ্টিবিনিময় হলেই তিনি চোখ নামিয়ে নিতেন মেঝের দিকে। শুনলাম তিনিই সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী।
তখনকার আনন্দবাজারের এক অর্থে কান্ডারি ছিলেন আর এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ। দেখতাম বেঁটেখাটো হলুদ তসরের পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকটিকে তাঁর অধস্তন সাংবাদিকরা বাঘের মতো ভয় পায়। আর ছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দীর্ঘদেহী ও মেদহীন। যিনি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন আনন্দবাজারের স্টাইল-গুরু, কাগজের সর্ব বিভাগ থেকে বাঙালির স্বভাবসুলভ কাব্যিকতা বর্জন করে পত্রিকার ভাষা তাঁর শরীরের মতো নির্ভার করে তোলার পথনির্দেশক। খেলাধুলা বিভাগের প্রধান ছিলেন সাহিত্যিক মতি নন্দী। প্রাক্-টেলিভিশন যুগে শুধু ভাষার জাদুতে কালকের ম্যাচকে পরিণত করতেন পরদিন সকালের কবিতায়। তা ছাড়া ছিলেন ছাত্রজীবনে কফি হাউস থেকে যে কবিদ্বয়কে দেখে আসছি সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলায় সৃষ্টিশীল লেখকদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষাজগতের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যদের এক বিপুল অংশ প্রত্যহ উপস্থিত হতেন আনন্দবাজার অফিসে।
সাহিত্যজগতের নক্ষত্রদের দৈনিক উপস্থিতি ও পত্রিকার শৈলীতে তার প্রভাব, অবশ্যই সত্তরের দশকের সাহিত্যমনস্ক মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে আনন্দবাজারকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এক সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের (‘কালচারাল হেজিমনি’) উচ্চাসনে। সেই চল্লিশের দশক থেকে বাংলার বামপন্থী দলগুলি প্রয়াস করছিল ওই উচ্চাসন দখল করার, এবং তাতে সফলও হয়েছিল। ষাটের দশকের শেষাশেষি বাম দল সফল হয় রাজনৈতিক বিচারেও, কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা এই যে আনন্দবাজার এক বড় ভাগ বসায় বামের সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে। সেই কৃতিত্বে আনন্দবাজারের সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের অবদান প্রচুর।
তার এক বড় দৃষ্টান্ত হলেন গৌরকিশোর ঘোষ (‘রূপদর্শী’) ও বরুণ সেনগুপ্ত। দু’জনেই বামবিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এক বড় ব্যবধান ছিল তাঁদের দু’জনের রাজনৈতিক অবস্থানে। বরুণবাবু ছিলেন মূলত কংগ্রেস দলের ক্ষমতাকেন্দ্রের সমর্থক, কিন্তু অন্য দিকে গৌরকিশোরবাবু ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তাঁর র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজ়ম-পন্থী, এবং সেই অর্থেই স্টালিনবাদী বামপন্থার বিরোধী। বরুণবাবুর কলাম কংগ্রেসের প্রতি যতই বদান্য হোক, এই কথা ভুললে চলবে না যে, আনন্দবাজারে তাঁর কলাম লেখার মধ্যাহ্নেও বাংলায় বামফ্রন্টের চেয়ে কংগ্রেসের ভোট ছিল মাত্র কয়েক শতাংশ কম এবং শহরাঞ্চলে, যেখানে আনন্দবাজার অপ্রতিরোধ্য, সেখানে কংগ্রেস ছিল নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ‘ডমিন্যান্ট’ শক্তি। অর্থাৎ কলামের লড়াকু ভঙ্গির অন্তরালেও ছিল এক অনস্বীকার্য জনসমর্থন।
কিন্তু তার অনেক আগে, ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন লেখক আনন্দবাজারে এমন সব লেখা লিখতে শুরু করেন, যা তুলে ধরে এক ঘুণধরা সমাজব্যবস্থার জাঁতাকলে আবদ্ধ মধ্যবিত্ত বাঙালির মনোজগৎ। ১৯৬৬ সালে আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় ‘যদি’ শিরোনামে সুনীলের এক সুদীর্ঘ সিরিজ়, যা তখনকার দিনে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। বক্তব্য ছিল, যদি সামাজিক সমস্যাগুলি মেটানো যায় কোনও কল্পিত উপায়ে, যাকে আজকের ভাষায় বলা যায় ‘হোয়াট ইফ?’, তবে কেমন হয়?
এক অর্থে তা পরাজয়ের দোরগোড়ায় উপস্থিত রাজ্যের কংগ্রেস সরকারকে অবহিত করা যে, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য সংলগ্ন করার প্রয়োজন সাধারণ মানুষকেও, এবং তার জন্য চাই মুক্ত ও প্রথাবর্জিত কল্পনাশক্তি। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে সুনীল লেখেন এক কল্পিত ব্যারাকবাড়ির কথা, যেখানে ভিখারি বালকবালিকাদের নিয়ে গিয়ে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ভবিষ্যৎ জীবনযাপনে সক্ষম হতে। এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ‘আদায়’ হয়েছে ধনী ব্যবসায়ীদের ভান্ডার হতে। আশ্চর্য, এটি সুনীল লিখেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন আয়কর আইনে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য কর্পোরেটদের করমুক্ত দানের কোনও সংস্থান ছিল না।
ওই ‘যদি’ সিরিজ়ের আর একটি লেখা আমাকে ছাত্রজীবনেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। তা ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ তারিখে লেখা: ‘দাবির সঙ্গে ত্যাগ মেলে—’। এক স্কুলশিক্ষক পুজোর ছুটির আগে চলেছেন মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে তাঁর ‘ডিউটি’ পড়েছে কিছু দিনের জন্য ‘বিনাপয়সায় গুরুগিরি’র, অর্থাৎ নিরক্ষরদের সাক্ষর করবার। সেই কল্পিত শিক্ষক বলছেন লেখককে: “ভাবছেন কি আমরা সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থে (বিনা পয়সায় গুরুগিরি) করছি? মোটেই না। শিক্ষকদের মর্যাদা ও আয় বৃদ্ধি চাই। প্রত্যেক শিক্ষককে গেজ়েটেড অফিসারের সমান মর্যাদা ও মাইনে দিতে হবে— এই নিয়ে আমরা শিগগিরিই বিরাট আন্দোলন শুরু করব।”
মনে পড়ে যায় এক দশক পরে বামফ্রন্ট সরকারের দাবিপত্রের কথা। স্কুলশিক্ষক তাঁর হৃত মর্যাদা ফিরে পান ১৯৭৭ পরবর্তী বামফ্রন্ট আমলে। তবে তার জন্য পুজোর ছুটিতে মাস্টারমশাইয়েরা ফ্রি গুরুগিরি করেননি। সামাজিক পরিবর্তনের চাপেই ১৯৮১-৯১ দশকে সাক্ষরতা বাড়ে ৪৮.৬ শতাংশ থেকে ৫৭.৭-এ। স্কুলশিক্ষক অর্জন করেন সরকারি কর্মচারীর সুযোগসুবিধা, কর্মস্থায়িত্ব এবং পেনশন।
আনন্দবাজারে আর এক ‘নব্যতা’র সূত্রপাত আশির দশকে। চাকরি ও শহর বদলের কারণে এই লেখক তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয়। কিন্তু ‘প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট’-এর খবর পাওয়া যেত সর্বত্রই। ওই দশকে আনন্দবাজারের প্রধান সম্পাদক অশোক কুমার সরকারের তিরোধানের (১৯৮৩) সময় থেকে পত্রিকাটির কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়। এবং সেই পরিবর্তনও সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বাংলায় মানুষের আর্থিক উন্নতি এবং শিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার তত দিনে তার ঔৎসুক্যের দিগন্তকেও ছড়িয়ে দিয়েছে পরিচিত গলিঘুঁজি ময়দানের থেকে অনেক দূরে। তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনে অন্তত দূরদর্শনটুকু দেখা যাচ্ছে। মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে ‘জাতীয়’ ম্যাগাজ়িন, তার মধ্যে একটি আনন্দবাজারের সহযোগী ইংরেজি সাপ্তাহিক: সানডে। তখন বিশ্ব রাজনীতিতে রেগন-থ্যাচার জুটির অভ্যুদয় হয়েছে। গোর্বাচভের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে সাবেক সোভিয়েট-তন্ত্রের পতনের সম্ভাবনা। বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকের মনে জেগেছে নতুন আগ্রহ।
আনন্দবাজার তার পাঠকের মননে পরিবর্তনটি প্রতিফলিত করে তার আঙ্গিক ও চিন্তাধারায়। এমনকি খবর সংগ্রহে ব্যয়ের বহরেও। ১৯৮৪ সালের কাগজে চোখে পড়বে আনন্দবাজার থেকে প্রেরিত সংবাদদাতা ওয়াশিংটন থেকে রোনাল্ড রেগনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনার জল মাপছেন। এখন সে সব জলভাত হলেও তখন তা ছিল না।
তা ছাড়াও সাহিত্যিকের চোখে ঘটনা পর্যবেক্ষণের সাবেক আনন্দবাজারি রীতিতে তখনও ভাটা পড়েনি। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর শিখ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার পর দিল্লি ও অন্যত্র শিখ গণহত্যার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার যে অবস্থান নিয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই পাঠানো হয়েছিল শিখবিরোধী দাঙ্গা সম্পর্কে লিখতে। এবং নভেম্বর ৬ তারিখের কাগজে তিনি লিখেছিলেন এক প্রবন্ধ, যার শিরোনাম ছিল, ‘গোটা শিখ সমাজ দোষী হবে কেন’। দিল্লিতে শিখদের বধ্যভূমি ত্রিলোকপুরীর ভস্মস্তূপের বর্ণনা লিখতে গিয়ে তিনি লিখলেন, “আমাদের আরাধ্য দেবতার চেয়ে বড় খুনী বোধ হয় কেউ নেই।” ইন্দিরার হত্যা যে বিশাল কালো ছায়া বিস্তার করেছিল মানুষের মনে, তার প্রভাবে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক পাপটি দিল্লির অনেক সংবাদপত্রেও কিছু দিন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, আনন্দবাজারের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী অবস্থান তখনও অনড়, অবিচল।
অবশ্য সেই বিশ্বাস অনড় হলেও তা সংবাদলেখকদের মনোজগতে প্রবিষ্ট করানো সহজ কাজ নয়। ক্রমশ আনন্দবাজার পত্রিকা প্রসারিত করেছে তার কভারেজ, সংবাদ পরিচালনার কাজে নিযুক্ত করছে উচ্চশিক্ষিত যুবকযুবতীদের, এবং বিপুল ব্যয় বহন করেছে সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এর ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকাশনার বৌদ্ধিক বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ মূল্য। কিন্তু এই প্রয়াসের অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি পরিশীলিত বাংলা পাঠকের সংখ্যা। যেটুকু বেড়েছে, তার একটা বড় অংশ চলে গিয়েছে ইংরেজি কাগজের ঝুলিতে। অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত পাঠক অভিবাসী হয়েছেন দেশের অন্য শহরে বা বিদেশে। সমাজের বৃহত্তর সেই সমস্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশিত হয়ে চলেছে সাংবাদিকতার নানা বাঁক, নানা দ্বন্দ্ব।
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অটলবিহারী বাজপেয়ী-পর্ব, তার পর দশ বছরের কংগ্রেস-চালিত ইউপিএ জমানা, অবশেষে ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীর শাসন। এর মধ্যে প্রায় সব সময়েই আনন্দবাজার পত্রিকা তার ‘নব্যতা’র সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে চেষ্টা করেছে এক আন্তর্জাতিক মানে নিজেকে উন্নীত করতে। এবং সেই কারণেই যুগবদলের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটি নিশ্চয় পুনর্বিচার করছে তার পাঠককে, পুনর্বিচার করেছে নিজের ভূমিকাকেও। না, গত বছরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন রিপোর্ট করতে কলকাতা বা দিল্লি থেকে ওয়াশিংটনে তার তরফে কেউ হাজির হননি। আনন্দবাজারের পাতাগুলিতে এখন যা অনুভব করা যায় তা অনেক বেশি ‘ঘরের খবর’। বাংলার নিজস্ব খবর।
কিন্তু সেটা আবার পরিবেশিত হয় দেশেবিদেশে ছড়ানো-ছিটানো বহু বাঙালি অধ্যাপক ও গবেষকের কলমে। যেন আনন্দবাজারের মাধ্যমে একটি সমগ্র জাতি খুঁজবার চেষ্টা করছে তার মূলের শিকড়গুলি।
কয়েক বছর আগে রাস্তায় আনন্দবাজারের বিলবোর্ডে এক পরিচিত লাইন ছিল: পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। লাইনটির মধ্যে ছিল এক আত্মশ্লাঘা। যেন অভিভাবক এসে পাঠককে বলছেন: উত্তিষ্ঠত। এখন আর লাইনটি দেখতে পাওয়া যায় না। শতবর্ষ উদ্যাপন মুহূর্ত যত এগিয়ে আসছে তত মনে হয় আনন্দবাজার পত্রিকা আলোকবর্তিকার অভিকাঙ্ক্ষী থেকে হয়ে উঠছে এক স্বচ্ছ আয়না, যেখানে বাঙালি পাঠক দেখবে তার আপন প্রতিফলন।
আনন্দবাজার পরিচালক নির্বাচনে, পরিচালনারীতিতে, মতপ্রচারে ও ব্যক্তিগত আচরণে যে নব্যতা দেখাইতেছে, উহার উদ্ভব ‘আনন্দবাজারেই’ হইতেছে না।
উহা আসিতেছে এই যুগের বাঙালি সমাজ হইতে, অন্ততপক্ষে সমগ্র বাঙালি সমাজের যে-ভাগে এখনও কিছু প্রাণ
আছে সেই অংশ হইতে। ‘আনন্দবাজার’ উহার প্রচারক মাত্র, উহাও হইয়াছে সংবাদপত্রটির কর্তৃপক্ষ স্ত্রী-পুরুষে নব্য বাঙালি সমাজভুক্ত বলিয়া।”
কথাগুলি লিখেছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ১৯৯৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত সাত দশক নামাঙ্কিত বিশেষ সঙ্কলনে। তার পর বাইশ বছর অতিক্রান্ত। আর এক বছর পরেই ‘আনন্দ-শতক’। এখন মনে হয়, নীরদচন্দ্রের পর্যবেক্ষণ তখনও ছিল নিখুঁত এবং তা আজও বহাল আছে। যে ‘নব্যতা’ আনন্দবাজার পত্রিকার ছত্রে ছত্রে আজও বিদ্যমান, তা কিন্তু কখনওই একই রকম ছিল না, এবং এখনও তা নিত্য বিবর্তিত হচ্ছে। তবে তার উৎসভূমি সর্বকালেই, নীরদচন্দ্রের ভাষায়, ‘সমগ্র বাঙালি সমাজের যে-ভাগে এখনও কিছু প্রাণ আছে সেই অংশ হইতে।’
এক সময় ছিল— এবং যে সময় আজ বহু দিন যাবৎ হারিয়ে গিয়েছে উপরের ‘লফ্ট’-এ নিক্ষিপ্ত অনেক কিছুর মতো— যখন বাঙালি সমাজের ‘প্রাণ’ ধুকপুক করত তার অসম্ভব সাহিত্যপ্রীতির ভিতর দিয়ে। সেটি সত্তরের দশকের কথা। সেই সময়েই এই লেখকের পরিচয় আনন্দবাজার ভবনের সঙ্গে। তবে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে নয়, সেই গোষ্ঠীরই ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’-এর সঙ্গে। আমার মনের মধ্যে তখনও বাংলা সাহিত্য বাসা বাঁধেনি এবং তার বিশেষ সম্ভাবনাও ছিল না, কারণ ডাক্তারি পড়ার মাঝদরিয়ায় হঠাৎ শেক্সপিয়রের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ইংরেজি অনার্সে নাম লিখিয়েছিলাম, মা-বাবার বদান্যতার সুযোগ নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে নমস্কার বিনিময়ের সম্পর্ক থাকলেও তখনও সেই সখ্য গড়ে ওঠেনি, যা কিছু গল্প উপন্যাস ও তাদের চরিত্রদের করে তোলে মানুষের আজীবন সঙ্গী।
অফিসে প্রথম হাজিরার দিন থেকেই শুনলাম, এটিই বাংলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর। সত্যই তা-ই। সিঁড়ি দিয়ে যিনি নেমে যাচ্ছেন তিনিই নাকি নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বাংলা ছোটগল্পের এক প্রধান কারিগর, যাঁকে তখনও চিনতাম শুধু সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ফিল্মের কাহিনিকার হিসেবে। আবার আমাদের নিউজ় ডেস্ক থেকে অনতিদূরে একটি ছোট টেবিলে বসতেন এক মুখচোরা ভদ্রলোক, যাঁর সঙ্গে সহসা দৃষ্টিবিনিময় হলেই তিনি চোখ নামিয়ে নিতেন মেঝের দিকে। শুনলাম তিনিই সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী।
তখনকার আনন্দবাজারের এক অর্থে কান্ডারি ছিলেন আর এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ। দেখতাম বেঁটেখাটো হলুদ তসরের পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকটিকে তাঁর অধস্তন সাংবাদিকরা বাঘের মতো ভয় পায়। আর ছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দীর্ঘদেহী ও মেদহীন। যিনি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন আনন্দবাজারের স্টাইল-গুরু, কাগজের সর্ব বিভাগ থেকে বাঙালির স্বভাবসুলভ কাব্যিকতা বর্জন করে পত্রিকার ভাষা তাঁর শরীরের মতো নির্ভার করে তোলার পথনির্দেশক। খেলাধুলা বিভাগের প্রধান ছিলেন সাহিত্যিক মতি নন্দী। প্রাক্-টেলিভিশন যুগে শুধু ভাষার জাদুতে কালকের ম্যাচকে পরিণত করতেন পরদিন সকালের কবিতায়। তা ছাড়া ছিলেন ছাত্রজীবনে কফি হাউস থেকে যে কবিদ্বয়কে দেখে আসছি সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলায় সৃষ্টিশীল লেখকদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষাজগতের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বাদ দিয়ে অন্যদের এক বিপুল অংশ প্রত্যহ উপস্থিত হতেন আনন্দবাজার অফিসে।
সাহিত্যজগতের নক্ষত্রদের দৈনিক উপস্থিতি ও পত্রিকার শৈলীতে তার প্রভাব, অবশ্যই সত্তরের দশকের সাহিত্যমনস্ক মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে আনন্দবাজারকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এক সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের (‘কালচারাল হেজিমনি’) উচ্চাসনে। সেই চল্লিশের দশক থেকে বাংলার বামপন্থী দলগুলি প্রয়াস করছিল ওই উচ্চাসন দখল করার, এবং তাতে সফলও হয়েছিল। ষাটের দশকের শেষাশেষি বাম দল সফল হয় রাজনৈতিক বিচারেও, কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা এই যে আনন্দবাজার এক বড় ভাগ বসায় বামের সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে। সেই কৃতিত্বে আনন্দবাজারের সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের অবদান প্রচুর।
তার এক বড় দৃষ্টান্ত হলেন গৌরকিশোর ঘোষ (‘রূপদর্শী’) ও বরুণ সেনগুপ্ত। দু’জনেই বামবিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এক বড় ব্যবধান ছিল তাঁদের দু’জনের রাজনৈতিক অবস্থানে। বরুণবাবু ছিলেন মূলত কংগ্রেস দলের ক্ষমতাকেন্দ্রের সমর্থক, কিন্তু অন্য দিকে গৌরকিশোরবাবু ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তাঁর র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজ়ম-পন্থী, এবং সেই অর্থেই স্টালিনবাদী বামপন্থার বিরোধী। বরুণবাবুর কলাম কংগ্রেসের প্রতি যতই বদান্য হোক, এই কথা ভুললে চলবে না যে, আনন্দবাজারে তাঁর কলাম লেখার মধ্যাহ্নেও বাংলায় বামফ্রন্টের চেয়ে কংগ্রেসের ভোট ছিল মাত্র কয়েক শতাংশ কম এবং শহরাঞ্চলে, যেখানে আনন্দবাজার অপ্রতিরোধ্য, সেখানে কংগ্রেস ছিল নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ‘ডমিন্যান্ট’ শক্তি। অর্থাৎ কলামের লড়াকু ভঙ্গির অন্তরালেও ছিল এক অনস্বীকার্য জনসমর্থন।
কিন্তু তার অনেক আগে, ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন লেখক আনন্দবাজারে এমন সব লেখা লিখতে শুরু করেন, যা তুলে ধরে এক ঘুণধরা সমাজব্যবস্থার জাঁতাকলে আবদ্ধ মধ্যবিত্ত বাঙালির মনোজগৎ। ১৯৬৬ সালে আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় ‘যদি’ শিরোনামে সুনীলের এক সুদীর্ঘ সিরিজ়, যা তখনকার দিনে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। বক্তব্য ছিল, যদি সামাজিক সমস্যাগুলি মেটানো যায় কোনও কল্পিত উপায়ে, যাকে আজকের ভাষায় বলা যায় ‘হোয়াট ইফ?’, তবে কেমন হয়?
এক অর্থে তা পরাজয়ের দোরগোড়ায় উপস্থিত রাজ্যের কংগ্রেস সরকারকে অবহিত করা যে, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য সংলগ্ন করার প্রয়োজন সাধারণ মানুষকেও, এবং তার জন্য চাই মুক্ত ও প্রথাবর্জিত কল্পনাশক্তি। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে সুনীল লেখেন এক কল্পিত ব্যারাকবাড়ির কথা, যেখানে ভিখারি বালকবালিকাদের নিয়ে গিয়ে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ভবিষ্যৎ জীবনযাপনে সক্ষম হতে। এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ‘আদায়’ হয়েছে ধনী ব্যবসায়ীদের ভান্ডার হতে। আশ্চর্য, এটি সুনীল লিখেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন আয়কর আইনে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য কর্পোরেটদের করমুক্ত দানের কোনও সংস্থান ছিল না।
ওই ‘যদি’ সিরিজ়ের আর একটি লেখা আমাকে ছাত্রজীবনেই উদ্বুদ্ধ করেছিল। তা ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ তারিখে লেখা: ‘দাবির সঙ্গে ত্যাগ মেলে—’। এক স্কুলশিক্ষক পুজোর ছুটির আগে চলেছেন মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে তাঁর ‘ডিউটি’ পড়েছে কিছু দিনের জন্য ‘বিনাপয়সায় গুরুগিরি’র, অর্থাৎ নিরক্ষরদের সাক্ষর করবার। সেই কল্পিত শিক্ষক বলছেন লেখককে: “ভাবছেন কি আমরা সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থে (বিনা পয়সায় গুরুগিরি) করছি? মোটেই না। শিক্ষকদের মর্যাদা ও আয় বৃদ্ধি চাই। প্রত্যেক শিক্ষককে গেজ়েটেড অফিসারের সমান মর্যাদা ও মাইনে দিতে হবে— এই নিয়ে আমরা শিগগিরিই বিরাট আন্দোলন শুরু করব।”
মনে পড়ে যায় এক দশক পরে বামফ্রন্ট সরকারের দাবিপত্রের কথা। স্কুলশিক্ষক তাঁর হৃত মর্যাদা ফিরে পান ১৯৭৭ পরবর্তী বামফ্রন্ট আমলে। তবে তার জন্য পুজোর ছুটিতে মাস্টারমশাইয়েরা ফ্রি গুরুগিরি করেননি। সামাজিক পরিবর্তনের চাপেই ১৯৮১-৯১ দশকে সাক্ষরতা বাড়ে ৪৮.৬ শতাংশ থেকে ৫৭.৭-এ। স্কুলশিক্ষক অর্জন করেন সরকারি কর্মচারীর সুযোগসুবিধা, কর্মস্থায়িত্ব এবং পেনশন।
আনন্দবাজারে আর এক ‘নব্যতা’র সূত্রপাত আশির দশকে। চাকরি ও শহর বদলের কারণে এই লেখক তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয়। কিন্তু ‘প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট’-এর খবর পাওয়া যেত সর্বত্রই। ওই দশকে আনন্দবাজারের প্রধান সম্পাদক অশোক কুমার সরকারের তিরোধানের (১৯৮৩) সময় থেকে পত্রিকাটির কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়। এবং সেই পরিবর্তনও সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বাংলায় মানুষের আর্থিক উন্নতি এবং শিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার তত দিনে তার ঔৎসুক্যের দিগন্তকেও ছড়িয়ে দিয়েছে পরিচিত গলিঘুঁজি ময়দানের থেকে অনেক দূরে। তখন ঘরে ঘরে টেলিভিশনে অন্তত দূরদর্শনটুকু দেখা যাচ্ছে। মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে ‘জাতীয়’ ম্যাগাজ়িন, তার মধ্যে একটি আনন্দবাজারের সহযোগী ইংরেজি সাপ্তাহিক: সানডে। তখন বিশ্ব রাজনীতিতে রেগন-থ্যাচার জুটির অভ্যুদয় হয়েছে। গোর্বাচভের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে সাবেক সোভিয়েট-তন্ত্রের পতনের সম্ভাবনা। বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকের মনে জেগেছে নতুন আগ্রহ।
আনন্দবাজার তার পাঠকের মননে পরিবর্তনটি প্রতিফলিত করে তার আঙ্গিক ও চিন্তাধারায়। এমনকি খবর সংগ্রহে ব্যয়ের বহরেও। ১৯৮৪ সালের কাগজে চোখে পড়বে আনন্দবাজার থেকে প্রেরিত সংবাদদাতা ওয়াশিংটন থেকে রোনাল্ড রেগনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনার জল মাপছেন। এখন সে সব জলভাত হলেও তখন তা ছিল না।
পর্বান্তর: মিখাইল গোর্বাচভ এবং রোনাল্ড রেগন। ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ শেষ হয়ে এল, এ বার বিশ্বশক্তির নতুন সমীকরণ তৈরি হবে।
তা ছাড়াও সাহিত্যিকের চোখে ঘটনা পর্যবেক্ষণের সাবেক আনন্দবাজারি রীতিতে তখনও ভাটা পড়েনি। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর শিখ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার পর দিল্লি ও অন্যত্র শিখ গণহত্যার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার যে অবস্থান নিয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেই পাঠানো হয়েছিল শিখবিরোধী দাঙ্গা সম্পর্কে লিখতে। এবং নভেম্বর ৬ তারিখের কাগজে তিনি লিখেছিলেন এক প্রবন্ধ, যার শিরোনাম ছিল, ‘গোটা শিখ সমাজ দোষী হবে কেন’। দিল্লিতে শিখদের বধ্যভূমি ত্রিলোকপুরীর ভস্মস্তূপের বর্ণনা লিখতে গিয়ে তিনি লিখলেন, “আমাদের আরাধ্য দেবতার চেয়ে বড় খুনী বোধ হয় কেউ নেই।” ইন্দিরার হত্যা যে বিশাল কালো ছায়া বিস্তার করেছিল মানুষের মনে, তার প্রভাবে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক পাপটি দিল্লির অনেক সংবাদপত্রেও কিছু দিন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, আনন্দবাজারের সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী অবস্থান তখনও অনড়, অবিচল।
অবশ্য সেই বিশ্বাস অনড় হলেও তা সংবাদলেখকদের মনোজগতে প্রবিষ্ট করানো সহজ কাজ নয়। ক্রমশ আনন্দবাজার পত্রিকা প্রসারিত করেছে তার কভারেজ, সংবাদ পরিচালনার কাজে নিযুক্ত করছে উচ্চশিক্ষিত যুবকযুবতীদের, এবং বিপুল ব্যয় বহন করেছে সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এর ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রকাশনার বৌদ্ধিক বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ মূল্য। কিন্তু এই প্রয়াসের অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি পরিশীলিত বাংলা পাঠকের সংখ্যা। যেটুকু বেড়েছে, তার একটা বড় অংশ চলে গিয়েছে ইংরেজি কাগজের ঝুলিতে। অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত পাঠক অভিবাসী হয়েছেন দেশের অন্য শহরে বা বিদেশে। সমাজের বৃহত্তর সেই সমস্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশিত হয়ে চলেছে সাংবাদিকতার নানা বাঁক, নানা দ্বন্দ্ব।
১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অটলবিহারী বাজপেয়ী-পর্ব, তার পর দশ বছরের কংগ্রেস-চালিত ইউপিএ জমানা, অবশেষে ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীর শাসন। এর মধ্যে প্রায় সব সময়েই আনন্দবাজার পত্রিকা তার ‘নব্যতা’র সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে চেষ্টা করেছে এক আন্তর্জাতিক মানে নিজেকে উন্নীত করতে। এবং সেই কারণেই যুগবদলের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটি নিশ্চয় পুনর্বিচার করছে তার পাঠককে, পুনর্বিচার করেছে নিজের ভূমিকাকেও। না, গত বছরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন রিপোর্ট করতে কলকাতা বা দিল্লি থেকে ওয়াশিংটনে তার তরফে কেউ হাজির হননি। আনন্দবাজারের পাতাগুলিতে এখন যা অনুভব করা যায় তা অনেক বেশি ‘ঘরের খবর’। বাংলার নিজস্ব খবর।
কিন্তু সেটা আবার পরিবেশিত হয় দেশেবিদেশে ছড়ানো-ছিটানো বহু বাঙালি অধ্যাপক ও গবেষকের কলমে। যেন আনন্দবাজারের মাধ্যমে একটি সমগ্র জাতি খুঁজবার চেষ্টা করছে তার মূলের শিকড়গুলি।
কয়েক বছর আগে রাস্তায় আনন্দবাজারের বিলবোর্ডে এক পরিচিত লাইন ছিল: পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। লাইনটির মধ্যে ছিল এক আত্মশ্লাঘা। যেন অভিভাবক এসে পাঠককে বলছেন: উত্তিষ্ঠত। এখন আর লাইনটি দেখতে পাওয়া যায় না। শতবর্ষ উদ্যাপন মুহূর্ত যত এগিয়ে আসছে তত মনে হয় আনন্দবাজার পত্রিকা আলোকবর্তিকার অভিকাঙ্ক্ষী থেকে হয়ে উঠছে এক স্বচ্ছ আয়না, যেখানে বাঙালি পাঠক দেখবে তার আপন প্রতিফলন।