Matua

নীলবাড়ির হিসাব পাল্টাতে পারে ৩০ আসন, মতুয়া-মন খুঁজছে বিজেপি

২০১৯ সালের লোকসভা মতুয়ারা বিজেপি-কে দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে দুই কেন্দ্র বনগাঁ ও রানাঘাটে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিল বিজেপি।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:৪০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে? বিজেপি-র কাছে এখন এটি লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ, দলের অঙ্ক বলছে, নীলবাড়ি দখল করতে হলে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট ঝুলিতে ভরতেই হবে। হিসেব এ-ও বলছে, প্রায় ৩০টি বিধানসভা আসনের ফলাফল এদিক-ওদিক করে দিতে পারেন গুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামীরা।

Advertisement

সেই কারণেই বনগাঁর সাংসদ তথা মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি শান্তনু ঠাকুরের ক্ষোভ প্রশমনে এত বেশি উদ্যোগী বিজেপি-র রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা। সম্প্রতি ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করা শান্তনুকে সন্তুষ্ট করতে ইতিমধ্যেই বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রকে আলাদা সাংগঠনিক জেলা ঘোষণা করে তাঁর ঘনিষ্ঠকে সেখানে সভাপতি করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে কার্যত শান্তনুর দাবি মেনেই জানুয়ারির সফরে ঠাকুরনগরে গিয়ে মতুয়া সমাজের সামনে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে পারেন অমিত শাহ। কারণ, বিজেপি বুঝতে পারছে, মতুয়া ভোট নিশ্চিত করতে না পারলে নীলবাড়ি দখলের স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।

অমিত রাজ্যে ২০০ আসন পাওয়ার লক্ষ্য বেঁধে দিলেও বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ১৫০ থেকে ১৬০টি আসনে জয় পেতে পারে পদ্মশিবির। এ-ও জানা গিয়েছে যে, ওই সমীক্ষার ক্ষেত্রে বিজেপি অনেকটাই নির্ভর করেছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের উপর। সেই নির্বাচনে মতুয়ারা বিজেপি-কে দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন। ফলে মতুয়াপ্রধান দুই লোকসভা কেন্দ্র বনগাঁ ও রানাঘাটে বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিল বিজেপি। বনগাঁয় শান্তুনু জেতেন ১ লাখের বেশি ভোটে। রানাঘাটে জগন্নাথ সরকার জয় পান ২ লাখেরও বেশি ব্যবধানে।

Advertisement

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গত লোকসভা নির্বাচনের বিধানসভা-ভিত্তিক ফল বলছে, ওই দুই কেন্দ্রেই ৭টির মধ্যে ৬টি করে আসনে এগিয়ে বিজেপি। লোকসভার মতো বিধানসভা নির্বাচনেও মতুয়া সমর্থন পেলে বনগাঁর কল্যাণী, হরিণঘাটা, বাগদা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ এবং গাইঘাটায় জয়ের আশা করছে বিজেপি। তৃণমূল ওই লোকসভা এলাকায় শুধু স্বরূপনগরে এগিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে রানাঘাটের ৭টি বিধানসভা এলাকার উপর আরও বেশি ভরসা বিজেপি-র। কারণ, লোকসভা নির্বাচনের বিধানসভা-ভিত্তিক ফলাফলে শান্তিপুর, রানাঘাট উত্তর-পশ্চিম, রানাঘাট উত্তর-পূর্ব, রানাঘাট দক্ষিণ, চাকদহ এবং কৃষ্ণগঞ্জে বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল বিজেপি। তৃণমূল এগিয়ে ছিল শুধু নবদ্বীপে। তা-ও আবার তুলনামূলক ভাবে খুবই কম (৪,০৬৪) ভোটের ব্যবধানে।

বিধানসভা নির্বাচনে বনগাঁ ও রানাঘাট লোকসভা এলাকার ১৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। তা ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর, হাবরা, সন্দেশখালি, পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর, কালনা, রায়নাতেও মতুয়া ভোট ‘নির্ণায়ক শক্তি’। সব মিলিয়ে এমন আসনের সংখ্যা গোটা ৩০। উত্তরবঙ্গেক মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলার অনেক বিধানসভা এলাকাতেও বড় সংখ্যায় মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটার রয়েছেন। মতুয়া মহাসঙ্ঘের একাংশের দাবি, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত রাজ্যের ৮৯টি বিধানসভা এলাকায় মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতেন। সেটা এখন বেড়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে মোট ১০২টি বিধানসভা এলাকায় পৌঁছেছে।

শান্তনু ঠাকুরের 'বিদ্রোহ' সামলাতে ঠাকুরনগরে যান কৈলাস বিজয়বর্গীয়।

ঘাসফুলের সঙ্গে থাকা মতুয়া ভোট গত লোকসভা নির্বাচনে পদ্মফুলের দিকে এসেছিল মূলত নাগরিকত্ব ইস্যুতে বিজেপি-র প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র করেই। কিন্তু দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকারের দেড় বছর কেটে গেলেও দেশে এখনও সিএএ কার্যকর হয়নি। করোনা আবহের কারণেই সেটা করা যায়নি বলে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হলেও মতুয়া সমাজ কি তা মেনে নেবে? এই প্রশ্ন থেকেই অতীতে মতুয়ামন জয় করেও ভয় যাচ্ছে না বিজেপি-র।

শান্তনুকে নিয়ে বিজেপি-র আশঙ্কার কারণ, তিনি শুধু সাংসদ নন, মতুয়া সমাজের আবেগ-কেন্দ্র ঠাকুরবাড়ির প্রতিনিধি। রাজ্য-রাজনীতিতে ঠাকুরবাড়ি যে দিকে যায়, সে দিকেই যায় মতুয়া ভোট। কিন্তু পাশাপাশিই দেখা গিয়েছে, মতুয়া-মন বড় অস্থির। রাজনীতিতে ঠাকুরবাড়ির প্রথম প্রতিনিধি ছিলেন প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। মতুয়াদের ধর্মগুরু প্রমথরঞ্জন কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক ও মন্ত্রী হন। পরে বাংলা কংগ্রেসের টিকিটেও বিধায়ক হন। তাঁর ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর তৃণমূলের টিকিটে জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সাংসদ হন মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণ। কপিলের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মমতাবালা উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী হলে বিজেপি টিকিট দেয় মঞ্জুলের বড় ছেলে সুব্রতকে। তখন মন্ত্রিত্ব ছে়ড়ে বিজেপি-তে যোগ দেন মঞ্জুলও। সে বার মঞ্জুলের বড়ছেলে সুব্রত হারলেও ২০১৯ সালে জেঠিমা মমতাবালাকে হারিয়ে দেন মঞ্জুলের ছোটছেলে শান্তনু।

এক সময়ে তৃণমূলের পক্ষেই ছিল মতুয়া মন। সাংসদ হয়েছিলেন তৃণমূলের মমতাবালা ঠাকুর।

প্রমথরঞ্জনের মৃত্যুর পর মতুয়াদের প্রধান হয়ে ওঠা ‘বড়মা’ বীণাপানি দেবীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু গত লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী সরকারের এনআরসি বিলে তৃণমূল সমর্থন দিক বলে দাবি তোলেন বড়মা। মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে পাঠানো বড়মার সই-করা চিঠিতে বলা ছিল, কেন্দ্রের নাগরিকত্ব বিলে সমর্থন না দিলে মতুয়ারা আর তৃণমূলের সঙ্গে থাকবে না। যদিও সেই চিঠির যাথার্থ্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ২০১৯-এর ৫ মার্চ বড়মার মৃত্যু হয়। তার আগেই অবশ্য ঠাকুরনগরে গিয়ে বড়মার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আসেন মোদী। তার ফল দেখা যায় লোকসভা নির্বাচনে।

আরও পড়ুন: শোভন-বৈশাখী নাট্যে যবনিকা চেয়ে দৌত্য বিজেপি-র, প্রথমাঙ্ক সমাপ্ত ডাল-ভাতে

আরও পড়ুন: শোভন-বৈশাখী নিয়ে রত্নাকে আপাতত নীরবই থাকতে নির্দেশ তৃণমূলের

প্রসঙ্গত, ডিসেম্বর মাসেই মমতা বনগাঁয় সমাবেশ করে মতুয়াগুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে ছুটি ঘোষণা করেছেন। সে দিন মমতা বলেছেন, ‘‘মতুয়াদের এত মানুষ আছে, তা আগে কেউ জানত না। অনেকেই হয়তো জানেন না, ৩০ বছর ধরে বড়মার চিকিৎসা আমিই করিয়েছি। যখনই অসুস্থ হয়ে পড়তেন, আমি বালুকে (খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক) বলতাম, ওঁকে কলকাতায় নিয়ে এসো।” মতুয়ামন পদ্ম থেকে ঘাসফুলে টানতে মমতা আরও বলেছেন, ‘‘আমরা বিজেপি পার্টি নয়। ভোটের সময় কথা দিলে কথা রাখি। ওরা ভোটের সময় মিথ্যে কথা বলে পালিয়ে যায়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement