দিনেরবেলা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফে ঢাকা শৃঙ্গ।
কলকাতা-সহ দক্ষিণের উপকূলবর্তী এলাকায় সকালের দিকে আকাশে মেঘ। তবে একটু বেলা বাড়তেই উত্তুরে হাওয়া উড়িয়ে দিচ্ছে। চামড়ায় টান ধরছে। আবার উত্তরবঙ্গের আকাশ এতটাই পরিষ্কার, যে একদিকে আলিপুরদুয়ার, অন্যদিকে রায়গঞ্জ থেকে দিনেরবেলাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফে ঢাকা শৃঙ্গ। বছরের এই সময়ে উত্তরবঙ্গের আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। তাই এমনকি, শিলিগুড়ি থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায় না। এ বছর তার ব্যতিক্রম দেখছেন উত্তরের মানুষ।
আবহবিদেরা বলছেন, দক্ষিণবঙ্গে গত কয়েকবছর এই সময়ে আকাশে যে পরিমাণ মেঘ থাকত, এবার সেই পরিমাণ তুলনায় অনেক কম। কলকাতা-সহ উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে মাঝেমাঝেই মেঘ জমলেও তার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ হচ্ছে না। আর দক্ষিণের বায়ুমন্ডলের সেই মেঘ উত্তরবঙ্গে পৌঁছতেও পারছে না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাতাসে জমে থাকা ধূলিকণার পরিমাণ। বস্তুত, উত্তরবঙ্গে এ ভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার কৃতিত্ব মূলত লকডাউনকেই দিতে চান আবহাওয়া গবেষকেরা।
আবহবিদেরা দেখেছেন গত মঙ্গলবার থেকে ডুয়ার্স এবং তরাইয়ের সব জায়গা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। অবাক করার মতো বিষয় হল, সেটা দুপুর পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকছে। আলিপুরদুয়ারের এক প্রবীণের মন্তব্য, ‘‘আলিপুরদুয়ার থেকে বছরের এই সময়টায় আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি ভোরবেলায়। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা মেঘে ঢাকা পড়ে যেত। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট।’’ ওই প্রবীণের আরও মন্তব্য, ‘‘এবার আরও একটা জিনিস নজরে এসেছে— তুফানগঞ্জের মতো দূরের এলাকা থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। এটা আগে কখনও হয়েছে বলে শুনিনি।’’
ডুয়ার্স এবং তরাইয়ের সব জায়গা থেকে এখন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা।
আরও পড়ুন: সন্তান হারানোর শোকে শামিল হননি, পুলওয়ামা নিয়ে বিরোধীদের নিশানা মোদীর
উত্তরবঙ্গের আকাশ এবার এমন মেঘমুক্ত, কারণ, পুজোর মুখে পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে একটি ঘূর্ণাবর্ত তৈরির আশঙ্কা দৃঢ় হয়েছিল। পুজোর প্রথম তিনদিন প্রবল বৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। সেই নিম্নচাপ তেলেঙ্গানা-অন্ধ্রপ্রদেশে ব্যাপক বৃষ্টি নমিয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করে ফেলে। ওড়িশাতেও সেটি ঢুকতে পারেনি। তার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে মেঘ আর তেমন নেই। সব টেনে নিয়ে গিয়েছে ওই নিম্নচাপ। তা হলে কলকাতা-সহ উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে সকালের দিকে মেঘ আসছে কোথা থেকে? কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকৃতিবিজ্ঞান মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলছেন, ‘‘তামিলনাড়ুতে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু ঢোকার সময় হয়েছে। তাই একটা নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। তারই জেরে হালকা মেঘ ঢুকছে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে উত্তুরে হাওয়ার প্রবাহ শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। তারা ওই সকালের মেঘকে এক জায়গায় জমতে দিচ্ছে না। ফলে বৃষ্টিপাতের আশঙ্কাও থাকছে না।’’ তাঁর আরও ব্যাখ্যা, ‘‘উত্তরবঙ্গে উত্তুরে হাওয়ায় প্রবাহটা তুলনায় বেশি। সেখানে দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসা কোনও মেঘ ঢুকতেই পারছে না। তাই আকাশ ঝলমল করছে।"
উত্তরবঙ্গের পরিবেশ সংগঠন ‘ন্যাফ’-এর তরফে অনিমেষ বসুর ব্যাখ্যা, ‘‘লকডাউনের জেরে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ একেবারেই কমে গিয়েছে। তার পরে পুজোর আগে ও পুজোর সময় বৃষ্টি বাকি ধুলোও ধুয়েমুছে দিয়েছে। আকাশেও মেঘ নেই। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরা দিয়েছে গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষের চোখে।’’ অনিমেষ বলেন, ‘‘কাঞ্চনজঙ্ঘার সব ক'টি শাখাশৃঙ্গ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে। শনিবারেও দেখছি। কাব্রু, সাউথ-নর্থ ডোম, পান্ডিম সব ক’টাই।’’
এখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরা দিয়েছে গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষের চোখে।
আরও পড়ুন: খুব শীঘ্রই টিকা আসছে দাবি মডার্নার, ট্রায়াল শেষের পথে জনসন অ্যান্ড জনসন, ফাইজারও
কতদিন দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা? আবহবিদেরা বলছেন, উত্তুরে হাওয়ার গতিবেগ বাড়লেই তাপমাত্রা নামবে। বাতাস ভারী হবে। কুয়াশা পড়বে। কমে যাবে দৃশ্যমানতা। তখন আর এই দৃশ্য না-ও দেখা যেতে পারে। তবে ধুলোবালি কম থাকায় এবার ধোঁয়াশার সম্ভাবনা কম। সব কিছুই নির্ভর করছে দেওয়ালির উপরে। যত বাজি পুড়বে, ততই বাতাসে ঘনত্ব বাড়বে ধোঁয়ার। বাতাস ভারী হয়ে নীচে নেমে আসবে। কার্বনকণার সঙ্গে কুয়াশার জলকণা মিলে তৈরি করবেএকটি সূত্র। কাঞ্চনজঙ্ঘা হারিয়ে যাবে আর ভারী দূষিত বাতাস চেপে বসবে বুকে। উত্তরের মতো একই ঘটনা ঘটবে দক্ষিণবঙ্গেও।