আহমেদ হাসান ইমরান।
প্রকাশক ইস্তফা দিয়েছেন। সম্পাদক পদে কেউ নেই। মালিকানা নিয়েও ধোঁয়াশা বিস্তর। তবু বহাল তবিয়তে প্রকাশিত হচ্ছে একদা সারদা গোষ্ঠীর হাতে থাকা সংবাদপত্র ‘দৈনিক কলম’! দিব্যি ছাপা হচ্ছে রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন। মুখ্যমন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী এক মন্ত্রীও নিয়মিত টাকা জোগাচ্ছেন বলে খবর।
এক সময়ে স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্টস অব ইন্ডিয়ার (সিমি) মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘কলম’ পত্রিকা। মালিক ছিলেন সিমি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ হাসান ইমরান। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে দহরম মহরমের অজস্র অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও যাঁকে দলের টিকিটে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইমরানের অবশ্য দাবি, সিমি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরে তিনি তাদের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ রাখেননি। যদিও ‘কলম’-এর প্রকাশ চালিয়ে গিয়েছেন মোটামুটি নিয়মিত ভাবে। তখন ‘কলম’ ছিল সাপ্তাহিক। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের অভিযোগ, তৃণমূলের চাপে বিপুল টাকা ঢেলে ইমরানের সেই ‘কলম’ পত্রিকাটিই দৈনিক হিসেবে প্রকাশ করতে বাধ্য হয় তাঁর বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা। তবে বিস্তর টাকা ঢাললেও কাগজের মালিকানা কখনওই হাতে আসেনি তাঁর।
কিন্তু সারদার টাকার স্রোত বন্ধ হওয়ার পরেও কী ভাবে প্রতিদিন বের হচ্ছে ‘কলম’? কে টাকা জোগাচ্ছে প্রতি মাসে?
সে বিষয়ে তত্ত্বতালাশ করতে গিয়েই গোয়েন্দাদের হাতে উঠে এসেছে মমতা-ঘনিষ্ঠ ওই প্রভাবশালী মন্ত্রীর নাম। ইডি এবং সিবিআই এখন সেই মন্ত্রীর গতিবিধির ওপরেও নজরদারি চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, শীঘ্রই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে।
সিবিআইয়ের এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ২০১৩ সালের মার্চে সারদার ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার পর তৃণমূলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় ও তাঁর অনুগত নেতা আসিফ খান ওই কাগজটি চালাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সিবিআই সূত্রের খবর অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল এ জন্য কলম-এর দফতরে বৈঠক করেছিলেন মুকুল রায়, আসিফ খান ও ইমরান। সিবিআই সূত্রে খবর আসিফ জেরায় জানিয়েছেন, মুকুল রায় এপ্রিল ও মে মাসে ওই পত্রিকা প্রকাশের জন্য টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। জেরায় মুকুল রায়ের কাছেও এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। এক তদন্তকারীর দাবি, মুকুল রায় বলেছেন দলনেত্রীর নির্দেশেই তিনি কলম সংবাদপত্রটি চালু রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন। আসিফ খানও এ বিষয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। কারাবন্দি আসিফ খানের আইনজীবী লোকেশ শর্মা জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেল সিবিআইয়ের কাছে দু’মাস ‘দৈনিক কলম’ চালানোর কথা স্বীকার করেছেন। তিনি ও মুকুল রায় মিলে দু’মাসে প্রায় আধ কোটি টাকা কলম কর্তৃপক্ষকে জোগাড় করে দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেছেন আসিফ। লোকেশ আরও বলেন, “এখন সে’টি কী ভাবে চলছে, ওই পত্রিকায় আরও কাদের স্বার্থ জড়িত ছিল এ সব বিষয়েও আমার মক্কেল সিবিআইকে সবিস্তার তথ্য দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করেছেন তিনি।”
কিন্তু ২০১৩-র মে মাসের পর থেকে কে টাকা জোগাচ্ছে কলম প্রকাশের?
সিবিআই সূত্রের খবর, মুকুল রায় এই প্রশ্নের জবাবে মমতার ছায়াসঙ্গী এক মন্ত্রীর দিকেই আঙুল তুলেছেন। এক সিবিআই কর্তার কথায় ওই নেতা সোজাসাপ্টাই বলেন, এ বিষয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতার একটি কেন্দ্রের বিধায়ক ওই মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। নেত্রীর নির্দেশে তিনিই এখন ওই কাগজ চালানোর টাকার বন্দোবস্ত করছেন। সিবিআই সূত্রের এই দাবির সত্যাসত্যের বিষয়ে বুধবার দিল্লিতে মুকুলবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি তা যেমন স্বীকার করেননি, আবার অস্বীকারও করেননি। নেত্রীর কোপে পড়ে দলের সব পদ হারিয়ে সাধারণ সাংসদে পরিণত হওয়া তৃণমূলের এই নেতা বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না!”
তবে সিবিআইকে দেওয়া মুকুলবাবুর বয়ানের সত্যতা মিলেছে বলেই ওই গোয়েন্দা-কর্তার দাবি। তাঁর সংযোজন, “আমরা এই মন্ত্রীর বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছি।” ‘দৈনিক কলম’ পত্রিকা চালানোর জন্য প্রতি মাসে ওই মন্ত্রী প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা ‘অনুদান’ জোগাড় করে দেন বলে দাবি করছেন এই তদন্তকারী। তিনি জানিয়েছেন, “কোন উৎস থেকে মন্ত্রী নিয়মিত এই টাকা জোগাড় করেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত আস্থাভাজন এই মন্ত্রীকে প্রয়োজনে জেরাও করা হবে।” এই অভিযোগের বিষয়ে ওই মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ‘দৈনিক কলম’ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেন। পরে তিনি আর ফোন ধরেননি।
ওই মন্ত্রী ছাড়া কিছু ব্যবসায়ীও বিজ্ঞাপন দিয়ে বা অন্য ভাবে নিয়মিত কলম প্রকাশের টাকা জোগাচ্ছেন বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। তাঁদের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছে সিবিআই। আইনকানুন ভেঙে প্রকাশিত সংবাদপত্রটিতে কী ভাবে সরকারি বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে, তার জবাবদিহি চেয়ে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কাছেও চিঠি পাঠাচ্ছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের এক কর্তা জানিয়েছেন, ওপর মহলের নির্দেশেই তাঁরা এই সংবাদপত্রটিকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। তিনি জানান, “একদা সারদা-র মালিকানায় থাকা একটি টেলিভিশন চ্যানেল এবং দৈনিক কলম সংবাদপত্রটিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এঁদের বিজ্ঞাপনের টাকাও দ্রুত মেটাতে বলা আছে।” কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জেনেছেন, অতি সম্প্রতিও বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে প্রায় ২৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে বেআইনি ভাবে চলা ‘দৈনিক কলম’কে।
কেন্দ্রের এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ২০১২-র ৫ এপ্রিল ‘কলম’ প্রথম দৈনিক আকারে প্রকাশিত হয়। তৃণমূলের এক অধুনা-পদত্যাগী সাংসদের ছাপাখানায় ওই কাগজ ছাপা শুরু হয়। দৈনিকটির সূচনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, “মা-মাটি-মানুষের খবর সংখ্যালঘু ভাইদের কাছে রোজ পৌঁছে দেবে এই কাগজ।” দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কাগজ ছাপা হতো। সিবিআইকে দেওয়া সুদীপ্ত সেনের বয়ান অনুযায়ী, কাগজ প্রতি লোকসান হতো ২ টাকা ৮০ পয়সা। সব মিলিয়ে ওই কাগজ চালাতে সারদার মাসে ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা লোকসান হতো বলে জানিয়েছেন সারদা-কর্তা। এর বাইরেও কম্পিউটার, ক্যামেরা ও গাড়ি কিনতে বিপুল টাকা খরচের কথা জানিয়েছেন তিনি। সিবিআই সূত্রে খবর, ৫ এপ্রিল ২০১২ থেকে ৩১ মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত শুধু ‘দৈনিক কলম’ চালিয়ে ৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে তাঁর বয়ানে জানান সারদা কর্তা। আর ওই কাগজটি নেওয়ার জন্য ইমরানের সংস্থাকে দিতে হয়েছিল ১৬ কোটি টাকা।
কলম পত্রিকার কার্যনিবার্হী সম্পাদক ইমরানের কাছ থেকে এই সংবাদপত্রের মালিকানা ও ব্যবসা নিয়ে সবিস্তার তথ্য চেয়েছিল সিবিআই ও ইডি। তিনি যে হিসেব ও দলিল পাঠিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গোয়েন্দারা অবাক। সিবিআইয়ের এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “ইমরানের দেওয়া তথ্যের ছত্রে ছত্রে অসঙ্গতি। এমনকী তাঁর দেওয়া দলিলেও প্রচুর অসঙ্গতি রয়েছে।” গোয়েন্দাদের জোগাড় করা তথ্য অনুযায়ী, এখনও প্রতিদিন ৪০ হাজার করে পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। কর্মী সংখ্যা কমিয়ে ও নানা ভাবে খরচ অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছেন ইমরান। কিন্তু তার পরেও এত লোকসান কী ভাবে সামলানো হচ্ছে? কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের এই প্রশ্নের জবাবে ইমরান কিছু নথি জমা দিয়েছেন, যা-ও অসঙ্গতিতে ভরা বলে অভিযোগ। খতিয়ে দেখার জন্য এ সব তথ্য আয়কর দফতরের অফিসারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল সাংসদ ইমরানের বক্তব্য জানতে চেয়ে বার বার ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি।
কিন্তু কেন তদন্তকারীরা দাবি করছেন ‘কলম’ বেআইনি ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে?
তদন্তে সিবিআই দেখেছে প্রকাশক ও মুদ্রক হিসেবে আমিন সিদ্দিকি ইস্তফা দিলেও এখনও ‘দৈনিক কলম’-এ তাঁর নাম ছাপা হচ্ছে। আমিন সিদ্দিকিকে বেশ কয়েক বার সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমিন সিদ্দিকি আনন্দবাজারকে বলেন, “পত্রিকাটির আয়-ব্যয়ের হিসেব জানতে চেয়ে আমি চার চারটি চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তার পরেও আমাকে অন্ধকারে রাখায় কয়েক মাস আগে আমি ইস্তফা দিই। কিন্তু আজও আমার নাম তারা প্রকাশ করে চলেছে!” সিদ্দিকি জানান, এ কথা সিবিআইকেও তিনি জানিয়েছেন। ‘কলম’-এর প্রকাশন সংস্থা দেশকাল প্রকাশন-এর বেশ কিছু নথিতে তাঁর স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে বলেও সিদ্দিকি সিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। ইমরানের দেওয়া নথিতে তাঁর স্বাক্ষর ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে খবর।
আইন ভাঙার আরও একটি বড় অভিযোগ উঠেছে। সিবিআইয়ের এক কর্তা বলছেন, ২০১৩-র মার্চ থেকে এই পত্রিকায় সারদার অনুদান বন্ধ হয়ে গেলেও আরএনআই-এর নথি থেকে এখনও সম্পাদক হিসেবে সুদীপ্ত সেনের নাম সরানো হয়নি। সেখানে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনও সারদা-র ‘৪৫৫ নম্বর ডায়মন্ড হারবার রোড’ ঠিকানা থেকেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হচ্ছে, যা অসত্য ঘোষণা। কলম পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ইমরানের নাম ছাপা হচ্ছে। কিন্তু পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কারও নামের উল্লেখ নেই। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “কলম দেশের একমাত্র দৈনিক পত্রিকা, যার কোনও সম্পাদক নেই।” তাঁর মতে, আরএনআই আইন অনুযায়ী এটা একেবারেই বেআইনি কাজ। অর্থাৎ দেশের আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই ২৩ মাস ধরে প্রকাশিত হচ্ছে কাগজটি।
সিবিআইয়ের এক কর্তার দাবি, ‘কলম’ পত্রিকার কার্যনিবাহী সম্পাদক ইমরানের সঙ্গে উপমহাদেশের জঙ্গিদের দীর্ঘ যোগাযোগের বিষয়টি উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও এনআইএ-র নানা তদন্তে। প্রশাসন সূত্রের খবর, মমতা তাঁকে প্রার্থী ঘোষণার পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব নবান্নে এসে ইমরানের জঙ্গি-যোগ সংক্রান্ত ফাইল তাঁর হাতে দিয়েছিলেন। ইমরান নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। তবে সিমি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি বলে দাবি ইমরানের। যদিও অভিযোগ, সিমি নেতাদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল তাঁর এই সংবাদপত্রের অফিসে। ইমরানের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাধানোর চক্রান্তের রিপোর্ট রয়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেও। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গি-যোগের রিপোর্ট দিয়েছেন, যা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সিমি-র একদা মুখপত্র ‘কলম’ পত্রিকাটি ইমরান নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছেন। সেই পত্রিকার রহস্যজনক আর্থিক সংস্থানের খোঁজ চালাতে গিয়ে আরও এক প্রভাবশালী মন্ত্রী জালে জড়াতে পারে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।