কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঘরের সামনে বসে রয়েছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। বুধবার। ছবি: মধুমিতা দত্ত
চা পেলেও চাবি পেলেন না।
বুধবার আচার্য-রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সফরের সারাংশ এটিই।
এ দিন কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে রাজ্যপালকে অভ্যর্থনা জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ ছিলেন না। উপাচার্য, দুই সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার বা অন্য কোনও কর্তাকে দেখা যায়নি। রাজ্যপালের গাড়ি সোজা পৌঁছে যায় দ্বারভাঙা ভবনের সামনে। ভিতরে ঢুকে তিনি প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মূর্তিতে প্রণাম করেন। প্রশ্ন করেন, ‘‘আমাকে স্বাগত জানাতে কেউ উপস্থিত নেই?’’ কেউ নেই জেনে তিনি খুবই অবাক হন। সিঁড়ি ভেঙে উঠে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিকে প্রণাম করে উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে ঢোকেন। এক কর্মী জানান, উপাচার্য আসেননি। উপাচার্যের ঘর তালাবন্ধ ছিল। আচার্য বলা সত্ত্বেও তা খোলা হয়নি। পাশে যেখানে সেনেট বৈঠক হয়, সেই হলেও তালা দেওয়া ছিল। ধনখড় বেশ কিছু ক্ষণ উপাচার্যের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে থাকেন।
আরও পড়ুন: ‘ছোট্ট মেয়েটা আর গুড লিখে দিতে বলবে না’
পরে রাজ্যপাল সাংবাদিকদের জানান, তিনি চেয়ে এক কাপ চা পেয়েছেন, কিন্তু উপাচার্যের ঘরের চাবি মেলেনি। তাই ঘরের বাইরেই বসে থাকতে হয়েছে। কর্মচারী সমিতি তাঁকে ফুলের স্তবক দেয়। সমিতির সদ্যসেরা বিভিন্ন দাবি লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তৃণমূল সমর্থিত কর্মচারী সমিতি মূল ফটকের দরজায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া একটি ফেস্টুন লাগিয়ে দেন।
এ দিন সেনেট-বৈঠকে থাকার কথা ছিল রাজ্যপালের। কিন্তু মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, অনিবার্য কারণে ওই বৈঠক স্থগিত থাকছে। উপাচার্য, রেজিস্ট্রারকে ডেকে পাঠান রাজ্যপাল। তিনি বলেন, ‘‘অনিবার্য কারণে বৈঠক স্থগিত। অনিবার্য কারণটা কী, জানতে ওঁদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ওঁরা জানান, রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা না-করার নির্দেশ আছে শিক্ষা দফতরের। এমন ঘটনা দেশের অন্য কোথাও কখনও ঘটেনি। একটি সরকারি দফতর, যার মাথায় কোনও মন্ত্রী আছেন, তারা এমন নির্দেশ দিচ্ছে।’’
এর পরে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘উপাচার্যকে বার্তা পাঠাই, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসব। গ্রন্থাগারও ঘুরে দেখব। তার পর থেকে উপাচার্যের মোবাইল আনরিচেবল, ল্যান্ডলাইন বন্ধ, ই-মেল করা হলে তা-ও ফিরে আসে।’’ রাজ্যপাল জানিয়ে দেন, তিনি ‘প্রোটোকল ওরিয়েন্টেড পার্সন’ নন। কিন্তু রাজ্যপাল ও আচার্য-পদের সম্মান রয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং চাইলে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু তিনি তা চাইছেন না। কেন উপাচার্য ক্যাম্পাসে থাকলেন না, তা জানতে চাইবেন। ধনখড় বলেন, ‘‘হয়তো উপাচার্যের অনুপস্থিত থাকার যথাযথ কারণ রয়েছে।’’ কেন চাবি মিলল না, তার কারণও তিনি খুঁজবেন বলে জানান রাজ্যপাল। তাঁর বক্তব্য, উপাচার্য নিশ্চয়ই চাবি বাড়ি নিয়ে যান না! শিক্ষায় রাজনীতিকরণের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘‘সব কিছু এখন নিয়ন্ত্রিত। আমি জানি, অনেকেই দমবন্ধ অবস্থায় রয়েছে। এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হতে পারে না। দয়া করে রিমোট কন্ট্রোলের ব্যাটারি খুলে দিন। বিধি মেনে কাজ করুন।’’
রাজ্যপাল এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারেও যান। সেখানে গ্রন্থাগারিক বা অন্য কর্তারা ছিলেন না। উপাচার্য বলেন, ‘‘সেনেট-বৈঠক যে হচ্ছে না, মঙ্গলবারেই তা আচার্যকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। সেনেট না-থাকায় আমি অন্য কর্মসূচিতে চলে গিয়েছিলাম।’’
আর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমার কথায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমি কখনওই হস্তক্ষেপ করি না। আমি যদি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বসে থাকতে চাই, সেটা যেমন সমীচীন নয়, তেমনই যখন-তখন আচার্য হিসেবে রাজ্যপালেরও যাওয়াটা দৃষ্টিনন্দন নয়।’’ তাঁর প্রশ্ন, আচার্য-পদটি তো আলঙ্কারিক। আচার্য হয়ে উনি যদি ভাবেন উপাচার্যের উপরে ছড়ি ঘোরাবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা ওঁর অধস্তন কর্মী, সেটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ নয়?
শিক্ষক সমিতির (কুটা) সাধারণ সম্পাদক পার্থিব বসু বলেন, ‘‘আচার্য এলে তাঁকে স্বাগত জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও উচ্চ পদাধিকারীর উপস্থিত না-থাকাটা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার পরিপন্থী।’’
বাংলায় সাংবিধানিক সঙ্কটের অভিযোগ তোলেন বিজেপি নেতা মুকুল রায়। ‘‘আচার্য হিসেবে রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। সব ঘর বন্ধ করে রেখেছেন উপাচার্য। উপাচার্য রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছেন। এই ঘটনার পুরো দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হবে,’’ বলেন মুকুল।
বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘রাজ্যপালের সঙ্গে বিরোধ করার যোগ্যতা শাসক দলের নেই। গোপাল গাঁধী যখন রাজ্যপাল ছিলেন, তাঁকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য কারা তাঁকে রাজনৈতিক ধর্না-মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলেন? যাঁরা তা করেছিলেন, তাঁরা কি বর্তমান রাজ্যপাল সরকারের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেছেন বলে এই অসভ্যতা করতে পারেন?’’ বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের দাবি, এতে রাজ্য সরকারের ইন্ধন যদি না-ই থাকে, তা হলে আচার্যকে অসম্মান করার জন্য উপাচার্যকে বরখাস্ত করা হোক।