শোভনকে নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ঘরে ফিরছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। সাধারণ নির্বাচনের শেষ দফার ভোটগ্রহণের দিনেই তেমনটা ঘটতে পারে বলে জল্পনা। শোভন নিজে জল্পনা সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেননি। আর যাঁর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে, সেই রত্না চট্টোপাধ্যায় খোলাখুলিই জানিয়েছেন যে, শোভনের ঘরের ফেরার সম্ভাবনার কথা তাঁর কানেও পৌঁছেছে। রত্না বিষয়টি নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন।
নিজের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি এখনও বেহালারই ভোটার। ১৯ মে সেখানেই নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাবেন স্থানীয় বিধায়ক তথা কাউন্সিলর শোভন চট্টোপাধ্যায়। যেখানে তিনি ভোট দেবেন, সেই ভোটগ্রহণ কেন্দ্র তাঁর বাড়ির লাগোয়া। বেহালার বাড়িটিতে শোভনের স্ত্রী রত্না থাকেন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। ভোট দিতে গিয়ে শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজের সেই বাড়িতে যেতে পারেন বলে খবর।
শোভনের ‘ঘর ওয়াপসি’ সংক্রান্ত জল্পনা আরও অক্সিজেন পেয়েছে রত্নার মন্তব্যে। শোভন চট্টোপাধ্যায় কি ফিরছেন? রত্না বলেন, ‘‘আমিও শুনছি।’’ আনন্দবাজারকে রত্না চট্টোপাধ্যায় আরও বলেছেন, ‘‘এই বাড়ি তো শোভন চট্টোপাধ্যায়েরই বাড়ি, দরজা সব সময় তাঁর জন্য খোলা। আমি তো চাইছি উনি ফিরে আসুন।’’
আরও পড়ুন: বাগনানে সত্তরোর্ধ ২ সমাজকর্মীকে মেরে হাড় ভাঙল দুষ্কৃতীরা, অভিযুক্ত তৃণমূল
বেহালার বাড়ি ছেড়ে প্রায় বছর দেড়েক আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন কলকাতার তৎকালীন মেয়র তথা রাজ্যের তদানীন্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। সেই থেকে গোলপার্ক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা তার আগে থেকেই চলছিল। স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ এবং প্রতারণার অভিযোগ তুলে শোভন জানিয়েছিলেন, রত্নার সঙ্গে কিছুতেই এক ছাদের তলায় থাকতে চান না, তাই বাড়ি ছেড়েছেন।
শোভনের ব্যক্তিগত জীবনের এই সিদ্ধান্ত অবশ্য ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল এর সঙ্গে। কলেজ শিক্ষিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই শোভন তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইছেন বলে রত্না অভিযোগ করেছিলেন। বৈশাখীর সঙ্গে শোভনের সম্পর্ক নিয়ে শোভনকে একাধিক বার প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীর ওই কটাক্ষ বা ভর্ৎসনাকে কেন্দ্র করেই দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে শোভনের দূরত্ব বাড়ে। শোভন মন্ত্রিসভা ছেড়ে দেন। তার পরে দলনেত্রী তাঁকে মেয়র পদ ছাড়তেও নির্দেশ দেন। বিধায়ক ও কাউন্সিলর পদে বহাল থাকেন ঠিকই, কিন্তু মন্ত্রিত্ব ও মেয়র পদ ছাড়ার পর থেকে দলের সব কর্মসূচিই তিনি এড়িয়ে চলা শুরু করেন। শোভনের গরহাজিরায় রত্না চট্টোপাধ্যায়কে সংগঠনে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। শোভন যে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, সেখানকার সাংগঠনিক কাজ দেখভালের দায়িত্ব রত্নাকে দিয়ে দেওয়া হয়। রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে বিচ্ছেদ মামলা তুলে না নিলে যে শোভনকে নিয়ে আর ভাববে না দল— এমন এক বার্তাই শোভনকে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় দলে রত্নার গুরুত্ব বাড়িয়ে। এমনটাই মনে করে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ।
শোভন কোনও আপসে যাবেন না এবং শোভন-বৈশাখী একসঙ্গে বিজেপি-তে যোগ দেবেন— এমন জল্পনা জোরদার হয়েছিল মাঝে। বৈশাখীর সঙ্গে বিজেপি নেতাদের বৈঠকও হয়েছিল একাধিক বার। কিন্তু সে প্রক্রিয়া পরে থমকে যায়। এ বার শোভনের ‘ঘর ওয়াপসি’ সংক্রান্ত যে চর্চা শুরু হয়েছে, তা সম্পূর্ণ উল্টো এক রাজনৈতিক জল্পনার জন্ম দিয়েছে। বিজেপি-তে যাওয়ার প্রশ্নই নেই, বরং দাম্পত্য বিবাদ মিটিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে তথা দলীয় স্তরে সক্রিয়তার বৃত্তেও শোভন ফিরতে চাইছেন বলে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে।
১৯ মে তিনি যে বেহালার বাড়িতে পা রাখতে পারেন, সে জল্পনা শোভন সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেননি। কিন্তু রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ফের জোড়া লাগানোর সম্ভাবনা তিনি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘ভোট দিতে যাওয়ার সঙ্গে বাড়ি যাওয়ার কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে নিয়ে এ রকম নানা কথা হয়। কোথা থেকে এ সব কথা আসে জানি না। আমি এ সব কথাকে পাত্তা দিই না।’’ তবে এই মন্তব্যের সঙ্গেই শোভনের সংযোজন, ‘‘ওই বাড়িতে কোনও দিন ফিরব না, এমন তো কখনও বলিনি। ওটা তো আমারই বাড়ি। বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে আমি ওখানেই ফিরব।’’ তা হলে ১৯ মে বেহালার বাড়িতে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা কি নেই? শোভন বলেন, ‘‘যদি যাই, তা হলে যথেষ্ট আইনি ব্যবস্থা নিয়েই যাব।’’ (এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে অবশ্য শোভন চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজারকে ফোন করে জানান, তিনি ১৯ মে বেহালার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেননি। শোভন বলেন, ‘‘আমি বলেছি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। বাড়ি যাওয়ার কথা বলিনি। বলেছি, যদি ভোটকেন্দ্রেও যাই, যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে যাব।’’)
আরও পড়ুন: ‘স্বাধীন ভারতে প্রথম সন্ত্রাসবাদী তো হিন্দুই ছিলেন, কমল হাসনের মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক
এতেই অবশ্য জল্পনা শেষ হচ্ছে না। ১৯ মে বেহালায় ভোট দিতে গিয়ে নিজের পুরনো বাড়িতে শোভনের পা রাখায় কোনও রাজনৈতিক বার্তা থাকছে কি না, তা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। রত্না চট্টোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য সে জল্পনা আরও উস্কে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘ওঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারটা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ওঁর ফিরে আসাই উচিত। আমি স্বাগতই জানাব।’’
আর যাঁর বিরুদ্ধে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের একরাশ অভিযোগ, সেই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলছেন এ প্রসঙ্গে? আনন্দবাজারকে তিনি বলেছেন, ‘‘শোভন চট্টোপাধ্যায় তাঁর কোন বাড়িতে কবে যাবেন বা কোন দিন যাবেন না, তা নিয়ে আমার কিছু বলার থাকতে পারে না। তিনি যা ভাল বুঝবেন, তা-ই করবেন।’’ কিন্ত যে ভাবে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছিল বৈশাখীকে, ১৯ মে-ও সে ভাবেই দেখা যাবে? দেড় বছর পরে যদি শোভন নিজের বাড়িতে ফের পা রাখেন, বৈশাখী কি সঙ্গে থাকবেন? কলেজ শিক্ষিকার জবাব, ‘‘সময়ই জবাব দেবে।’’
শোভন বার বার দাবি করেছেন, বৈশাখী তাঁর ‘বিপদের দিনের বন্ধু’। বৈশাখীও ‘বন্ধুত্ব’ তত্ত্বেই অটল থেকেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই যে ভাবে খোদ দলনেত্রীর কটাক্ষ শুনতে হয়েছে শোভনকে এবং শোভনের স্ত্রী ও শ্বশুর যে ভাবে প্রকাশ্যে তোপ দেগেছেন বৈশাখীর বিরুদ্ধে, তাতে তৃণমূলের জন্য শোভনের ফের সক্রিয় হওয়ার জল্পনাকে বৈশাখী কী চোখে দেখছেন? এ প্রশ্নের কোনও জবাব বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় দেননি। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্ত জানাচ্ছে, রায়চকে সাংঘাতিক হেনস্থার সম্মুখীন হওয়া নিয়ে বৈশাখী এখনও তেতে। শোভনের রাজনৈতিক ‘ঘর ওয়াপসি’ সংক্রান্ত জল্পনা নিয়ে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন বলে খবর।