রাস্তা আটকে বিক্ষোভ। মেদিনীপুরে।
প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওড়াতে পারছেন না প্রশাসনের একটি অংশও। তাঁদের মতে, নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে দাবিই করুন, চাকরি-প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা সরকার প্রকাশ না করায় প্রশ্ন থাকছেই। আর সে কারণেই বিক্ষোভ-আন্দোলন এ ভাবে বাড়তে বাড়তে রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। শাসক দলের একাংশও এখন বলছেন, সরকার তালিকা প্রকাশ করেনি বলেই অভিযোগ থামানো যাচ্ছে না।
শিক্ষা দফতরের অনেকের বক্তব্য, তৃণমূল আমলে ‘টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট’ বা টেট দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে এ পর্যন্ত দু’বার। এবং তা বাম আমলের নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিয়মে বদল ঘটিয়ে। অভিযোগ, সেই বদল ঘটাতে গিয়েই স্বচ্ছতা বাড়ার পরিবর্তে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কীসের অস্বচ্ছতা? গত বার আমাদের বিরুদ্ধে টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছিল। এ বার সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা রেখেই নিয়োগ চলছে।’’
কিন্তু কেন বিভিন্ন মহল থেকে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠছে?
শিক্ষা দফতরের একাংশের ব্যাখ্যা, বাম জমানায় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ করত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। তখন শূন্য পদের সংখ্যা দেখে নিয়োগের তালিকা তৈরি হত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে ২০১০ সালে শেষ বার এই নিয়োগের মাধ্যমে কয়েক হাজার ছেয়েমেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলেন। সে বার মাধ্যমিকের নম্বর আর প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষণ বা পিটিটিআই-এর উপর ‘মূল্যমান’ বা ‘ওয়েটেজ’ ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ৬৫ এবং ২২ নম্বর। লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল ১০ নম্বরের। ১০০-এর মধ্যে বাকি ৩ নম্বর বরাদ্দ ছিল প্রার্থীর অতিরিক্ত কর্মকুশলতার (এক্সট্রা কারিকুলার) জন্য। সে বার কোনও মৌখিক পরীক্ষা ছিল না। শিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানান, তখন মাধ্যমিকে স্টার মার্কস আর শিক্ষক প্রশিক্ষণে মোটামুটি ভাল নম্বর যাঁদের ছিল, তাঁদের প্রাথমিকে চাকরি পেতে তেমন সমস্যা হয়নি। এবং তালিকা প্রকাশের আগেই প্রার্থীরা হিসেব-নিকেশ করে বুঝতে পারতেন, কে কত নম্বর পাবেন।
আরও পড়ুন: কোর্টে না গিয়ে অফিসে আসুন: পার্থ
তা হলে কি বাম জমানায় নিয়োগ সবটাই স্বচ্ছ ছিল?
সেই আমলে দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান শনিবার দাবি করেন, ‘‘কিছু সুপারিশ মানতেই হতো। কিন্তু সে সব ছিল সংরক্ষিত ক্যাটেগরিতে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত প্রার্থী পাওয়া মুশকিল হতো। কিন্তু সাধারণ ক্যাটেগরিতে প্রায় কিছুই করার থাকত না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটি উদাহরণ হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু এখনকার মতো টেটের নম্বরের অদল-বদল ঘটিয়ে যা খুশি করার সুযোগ একেবারেই ছিল না।’’
জমানা বদলের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেই নিয়ম ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে। এখনকার শিক্ষাকর্তারা বলছেন, ওই নিয়ম বদলাতে হয়েছে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার্স এডুকেশন (এনসিটিই)-এর নির্দেশেই।
কী রকম? শিক্ষা দফতরের একাংশ জানাচ্ছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় ভাবে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয় রাজ্য পর্ষদের হাতে। নিয়োগ পরীক্ষার নাম দেওয়া হয় টেট। এই আমলে সেই টেট হয়েছে দু’বার। প্রথম ২০১২ সালে। তার নিয়োগ হয় ২০১৪ সালে। পরের বার পরীক্ষা হয় ২০১৬ সালে।
টেট-এ নিয়মের বদল কী হল?
পর্ষদ কর্তারা জানাচ্ছেন, ২০১২ সালে টেট পরীক্ষায় মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে লিখিত পরীক্ষার জন্য ৪০ এবং মৌখিকের জন্য ১০ নম্বর ধরা হয়েছিল। বাকি ৫০ নম্বরের মূল্যমান করা হয়েছিল প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ এবং অতিরিক্ত কর্মকুশলতার উপর। অনেকের মতে, নিয়মের এই বদলের ফলেই অনেক ভাল নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক হওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কারণ, ভাল নম্বর থাকার পাশাপাশি টেট-এ ভাল ‘স্কোর’ থাকাটাও তখন জরুরি হয়ে পড়ে। আর সেই ফাঁক গলে এমন অনেকেই নিয়োগ পান, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অতি সাধারণ হলেও টেট-এর স্কোর ‘অসাধারণ ও অবিশ্বাস্য’! যার জেরে ২০১৪ সালে নিয়োগের সময় টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। এমনকী, শাসক দলের বিধায়কদের বিরুদ্ধে কোটায় পাওয়া চাকরি বিক্রির অভিযোগও ওঠে। তবে সে সময় চাকরি-প্রার্থীদের নামের তালিকা রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল।
এ বার সেই তালিকাটুকুও বেমালুম গায়েব— বলছেন পর্ষদের একাধিক কর্তা! সেই সঙ্গে হয়েছে একাধিক বদল। আর তার জেরে অভিযোগের পাহাড় জমেছে।
কী রকম?
শিক্ষাকর্তারা বলছেন, যে নম্বর কমানো-বাড়ানো ঘিরে আপত্তি উঠেছিল, ২০১৬-য় তা আরও বদলানো হল। তখন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মোট মূল্যমান বাড়িয়ে করা হল ৬৫। আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য দক্ষতা খাতে নম্বর আরও কমিয়ে করা হল ৩৫। এতে দেখা যায়, সরকার প্রায় ১২ হাজার প্রশিক্ষিতকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও হাজার হাজার প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রার্থী টেট পরীক্ষায় পাশই করতে পারেননি। অথচ যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন রয়েছে। আরও অভিযোগ, কোনও চাকরির পরীক্ষার ফলাফল ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু এখানে তা হয়েছে। সর্বোপরি এ বার কোনও তালিকাই প্রকাশ করা হয়নি। ২০১৭ সালে নিয়োগপ্রাপ্তদের ‘সুখবর’ জানানো হয়েছে এসএমএস করে। পর্ষদের দাবি, নিয়োগবিধি অনুযায়ী চূড়ান্ত তালিকা তৈরির দায়িত্ব জেলা প্রাথমিক সংসদগুলির, তাদের নয়। সেই কারণেই কেন্দ্রীয় ভাবে কোনও তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু জেলা সংসদগুলি কেন তালিকা প্রকাশ করল না, সে প্রশ্নের সঙ্গত জবাব মেলেনি।
শিক্ষা মহলের একাংশের প্রশ্ন, আগে শূন্য পদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হতো। এ বার তা হলে কেন শূন্য পদের (৪২ হাজার) তিন গুণের বেশি প্রার্থীকে টেট-এ পাশ করানো হল? অভিযোগ উঠেছে, অনেক বেশি প্রার্থী পাশ করায় এক শ্রেণির দালালের সুবিধা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার টোপ দিয়ে তারা অনেক বেশি প্রার্থীকে ‘অফার’ দিতে পারছে। এই অভিযোগ আরও গুরুত্ব পেয়েছে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া সামলানোর দায়িত্ব একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকায়। এবং এই কারণেই নিয়োগের অনুমোদনটুকু দেওয়া ছাড়া স্কুল শিক্ষা দফতরের কোনও আমলা এর সঙ্গে নিজেদের জড়াতে চাননি।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য অনড়। তাঁর সাফ কথা, ‘‘প্রমাণ দিতে হবে। এমনি এমনি যা খুশি অভিযোগ তুললে হবে না।’’
বিক্ষোভ রাজ্য জুড়ে
• পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও বর্ধমানের জেলা সদর, বীরভূমের সিউড়ি, কলকাতার আলিপুর, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ। শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা সদর, দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডী।