তাণ্ডব: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ইউনিয়ন রুমে ভাঙচুরের পরে । ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ছাত্রছাত্রীদের তরফে ‘বাড়াবাড়ি’ হয়ে থাকতে পারে। তবু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার সারা দিনের গোলমাল-পর্বে কোনও ‘বৃহত্তর দুরভিসন্ধি’র ইঙ্গিত উড়িয়ে দিতে পারছেন না ওঁরা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক দশকের সাক্ষী প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষককুল কিংবা এ রাজ্যে ছাত্র-রাজনীতি খুব কাছ থেকে দেখা প্রবীণেরা এই মতেই স্থিত হচ্ছেন।
ঘটনাচক্রে এ দিন অন্য একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে যাদবপুরেই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে গোলমালের খবর কিছুটা কানে এসেছিল তাঁর। পরে সংবাদমাধ্যমে দেখেশুনে প্রাথমিক ভাবে স্বপনবাবুর মনে হচ্ছে, ‘‘ছাত্রছাত্রীরা যদি ভুল করেও কোনও উস্কানির ফাঁদে পা দিয়ে থাকেন, তবে তা দুর্বুদ্ধির পরিচয়।’’ কিন্তু সব মিলিয়ে যা ঘটছে, তার মধ্যে এক ধরনের বিপদ-সঙ্কেতই দেখছেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ। মন্ত্রীর সঙ্গে পড়ুয়াদের গোলমালের পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়ন রুমে রাজনৈতিক দলের ছেলেদের ভাঙচুরের অভিযোগ নিয়ে স্বপনবাবু বিচলিত। ‘‘মনে হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা ও তাণ্ডবকে বৈধতা দেওয়ার মঞ্চ তৈরি হচ্ছিল। কোনও মন্ত্রী উস্কানি দিয়ে থাকলে তা যে তিনি ইচ্ছে করেই করেছেন, এমনটা ভাবার কারণ রয়েছে। ক্যাম্পাসে বা রাজ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিস্থিতি তো এড়ানো উচিত।’’
বাবুল সুপ্রিয়ের আচরণ মন্ত্রীসুলভ নয় বলেই সরাসরি তোপ দেগেছেন যাদবপুরের ইংরেজি সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা তথা মানবীবিদ্যা চর্চা কেন্দ্রের প্রাক্তন অধিকর্তা মালিনী ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘মন্ত্রী এনআরসি-র মতো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন। তার প্রতিবাদ তো কেউ করতেই পারেন। মন্ত্রী তা থামানোর চেষ্টা করেননি। পাল্টা উস্কানি দিয়েছেন।’’ ছাত্রী হিসেবেও স্নাতকোত্তর স্তরে যাদবপুরের প্রাক্তনী মালিনীদেবীর প্রশ্ন, ‘‘এর পরে দলের ছেলেদের (যাঁদের কারও কারও বয়স ছাত্রদের থেকে অনেকটা বেশি) ডেকে এনে ইউনিয়ন রুমে ভাঙচুরের মাধ্যমে যা ঘটানো হল, তা কি শান্তি রক্ষার চেষ্টা? আমার তো উল্টোটাই মনে হয়।’’
রং মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে চে গেভারার ছবিতে। নিজস্ব চিত্র
শুধু মন্ত্রী বনাম ছাত্রছাত্রীদের একাংশের সংঘাত নয়, রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ক্যাম্পাসে। ‘মন্ত্রীর উস্কানি’ এবং ‘পড়ুয়াদের হঠকারি প্রতিবাদ’— এই লব্জের বাইরে এসে কথা বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান তথা অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র, যিনি আবার রাজ্যে শাসক দল তৃণমূলের সর্বভারতীয় শিক্ষা ফোরামের সভাপতি। ওমপ্রকাশবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যপাল বা তাঁর দফতরের জড়িয়ে পড়াটা উচিত হয়নি। এটা অতি-সক্রিয়তা।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওশেনোগ্রাফি-র এমেরিটাস অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘ক্যাম্পাসের এই সমস্যার সমাধান করতে রাজ্যপালকে কেন যেতে হল? এটা ভাল লাগেনি।’’ আনন্দদেববাবুও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। প্রবীণ অধ্যাপক বলছেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ করার অধিকার যেমন আছে, ঠিক তেমনই কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরও ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাঁকে বাধা দেওয়া ঠিক নয়।’’
যাদবপুরের ভাবমূর্তি যাতে নষ্ট হয়, তেমনই অভিসন্ধি সুকৌশলে কাজ করেছে বলে মনে করছেন অনেকে। সত্তরের দশকে নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রাক্তন ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘অনেকের চোখেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র বা রাজ্যে বিরোধী শক্তির মুখ। যাদবপুরে উস্কানি ছড়ানোর চেষ্টা পরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমরা বহু ছাত্র আন্দোলন করেছি। যাদবপুরে যাঁরা ভাঙচুর করলেন, তাঁরা হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এ সব করেছেন বলে মনে হচ্ছে না। মন্ত্রী গেলেন, কিছু ঘটনা ঘটল, রাজ্যপাল নবান্নে ফোন করে গেলেন, এবং তার পরে এত ভাঙচুর, গোলমাল ঘটল।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা কিছু বাড়াবাড়ি করলেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনাটি পরিকল্পিত বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদদের অনেকেই।