নারী-শক্তি: বালিগঞ্জের একটি স্কুলে ছুটির পরে খুদে পড়ুয়াদের সঙ্গে তাদের মায়েরা। নিজস্ব চিত্র
সম্প্রতি চতুর্থ বারের জন্য দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডে দোষীদের ফাঁসির দিন ধার্য হয়েছে। বারবার দিন পিছিয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ নাগরিকদের একাংশ। ২০১২ সালের ওই ঘটনার পরে নারী-সুরক্ষায় নতুন আইন প্রণয়ন হলেও ধর্ষণ থামেনি। তালিকায় যোগ হয়েছে কামদুনি, পার্ক স্ট্রিট, উন্নাও, কাঠুয়া, হায়দরাবাদের নাম। অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবির পাশাপাশি কেউ কেউ আবার বলার চেষ্টা করেছেন, ‘দোষ’ ছিল নির্যাতিতারই। দিল্লির ঘটনায় দোষীদের আইনজীবী এ পি সিংহ অক্লেশে জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গে পথে বেরোলে তাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিতেন তিনি! হায়দরাবাদে গণধর্ষণের ঘটনায় নির্যাতিতার চরিত্রহননের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধেই।
স্বাভাবিক ভাবে তাই প্রশ্ন উঠছে, এই নারী-বিদ্বেষের উৎস কোথায়? শিশুদের লালনপালনে, মূল্যবোধ গড়ে তোলায় কি কোথাও খামতি থেকে যাচ্ছে?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপিকা সংযুক্তা দাশগুপ্তের মত, এই নৃশংসতা আসলে নারীদেহের প্রতি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বহু পুরুষের কাছেই কোনও নারী এক জন মানুষ নন, শুধুই বস্তু। এই ভাবনার বীজ প্রোথিত হয় পরিবারে। একটি ছেলে বা মেয়ের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তা শেখানো হয় ছোট থেকে। আর কন্যাসন্তান সেই ছক ভাঙলেই সে হয়ে যায় ‘অলক্ষ্মী’। শুধু লিঙ্গ পরিচয়ের জোরেই একটি ছেলে নিজেকে মেয়েদের থেকে উচ্চতর বলে মনে করতে শুরু করে। সংযুক্তা বলেন, ‘‘সম্প্রতি অল্পবয়সি, চাকরিরতা বা পড়ুয়া মেয়েদের উপরে আক্রমণ বেশি ঘটছে। ‘সহবত’ শেখানোর মনোভাব থেকেই এমন হচ্ছে কি না, তা ভাবতে হবে।’’
যে বৈষম্যমূলক আচরণের বীজ পোঁতা হচ্ছে শিশুদের মনে, তার বৃদ্ধি রোখা যাবে কোন পথে? এই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে সচেতন মায়েদের। তাঁদের মতো তাঁদের মেয়েরাও কি লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হবে? রাতপথে বেরোতে ভয় পাবে তারাও? কাজের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে শুধু নারী বলেই? তাঁদের ছেলেরাও কি জীবনসঙ্গিনীকে বলবে— ‘‘সারা দিন বাড়িতে বসে কী করো?’’ কোনও নারীর শরীর ছোঁবে সম্মতি না নিয়েই?
বছরখানেক আগে পুত্রসন্তানের মা হওয়া, কর্পোরেট-চাকুরে স্মৃতি শাসমল বলছেন, ‘‘এ প্রজন্মের মায়েরা ছেলেদের আগে ভাল মানুষ হিসেবে বড় করতে চাইবেন। আমরা সচেতন, কোথায় খামতি রয়ে যায় সেটা জানি। দেখেছি, কী ভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হতে আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে যায়। তাই তথাকথিত ‘পৌরুষ’-এর ধারণা কতটা ভ্রান্ত, তা সন্তানকে বোঝাতে পারব।’’ স্মৃতি জানান, ছোট থেকেই ছেলেকে বোঝাতে চান, প্রাকৃতিক ভাবে নারী-পুরুষ আলাদা হলেও অধিকারে তফাত থাকা উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘‘সন্তানদের কথা ভেবেই এই শিক্ষাটা দিতে হবে মায়েদের।’’
পরিবর্তনের লড়াইটা যে পরিবার থেকেই শুরু হওয়া দরকার, তা বলছেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষও। তিনি জানান, কন্যা ও পুত্রসন্তানের সঙ্গে ব্যবহারে তফাত করা চলবে না। পায়েল বলেন, ‘‘ছোট্ট ছেলে যদি দেখে, সব সময়ে তার মাকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলা হচ্ছে, তা হলে তার মধ্যেও মেয়েদের সম্মান দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠবে না। অন্য দিকে, এমন আচরণকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারে একটি মেয়েও। এই শিক্ষাই অনেকে জীবনভর বহন করে।’’
মেয়েদের স্থান রান্নাঘরেই— এ দেশে এমন হামেশাই বলে থাকেন রাজনৈতিক নেতারা। ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে দশক গড়ায়। বৈষম্যের মানসিকতা বদলাতে তাই আগে প্রয়োজন সামাজিক সদিচ্ছার। আনুষ্ঠানিকতায় নয়, নারী দিবসের উদ্যাপন চলুক সে পথে হেঁটেই।