মগ্ন: রাতের কাটোয়াগামী ট্রেনের মহিলা কামরায় মোবাইলেই মন যাত্রীদের। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
কলোনির এবড়োখেবড়ো রাস্তা। ছুরির মতো মুখিয়ে রয়েছে ইট। সেই রাস্তা দিয়েই ছেঁড়া চটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক যুবতী। পরনে মলিন শাড়ি। পিঠে আলগা বেণী।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার সেই দৃশ্য। সাদা-কালো চলচ্চিত্রে কর্মরতা মহিলার প্রতিদিনের যুদ্ধ শুরুর জলজ্যান্ত তর্জমা। নীতা-রা কিন্তু আজও এমন ভাবেই কলোনি, অলি-গলি, গ্রাম, মফস্সল পেরিয়ে ট্রেনে করে শহরে আসেন, রুজির খোঁজে। এঁদের কেউ সরকারি চাকুরে, কেউ আনাজ বিক্রেতা। কিন্তু এঁদের প্রত্যেকেরই দিনের একটা অংশ জমা থাকে ট্রেনের মহিলা কামরায়। বিগত এক দশকে কতটা বদলেছে সেই কামরার অন্দরমহল? প্রশ্ন করা গেল ওঁদেরই কয়েক জনকে।
প্রশ্ন শুনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন মহিলা কামরায় বসে থাকা অনেকেই। এক মহিলা বলে উঠলেন, ‘‘নন্দিতাদি আপনি বলুন! আপনি তো অনেক দিন ট্রেনে যাতায়াত করছেন।’’ যাঁর উদ্দেশ্যে বলা, সেই নন্দিতা দাশগুপ্তের বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, পেশায় শিক্ষিকা। বললেন, ‘‘নতুন মুখ আসে, পুরনো মুখ চলে যায়। এই যা। তবে এখন মহিলা কামরায় আগের চেয়ে ভিড় বেশি হয়।’’ তা হলে কি কর্মরতা মহিলার সংখ্যা বেড়েছে? পেশায় নার্স প্রিয়া দাস বলছেন, ‘‘সকলেই যে কাজ করেন, এমন নয়। অনেকেই পড়ুয়া। কলকাতায় পড়তে যাওয়ার ঝোঁক এখন বেড়েছে। টালা সেতু বন্ধের জেরে ট্রেন পৌঁছতে দেরি করলে আরও সমস্যা।’’ পাশ থেকে নন্দিতাদেবী বললেন, ‘‘এখন অনেকেই কাজে বেরোচ্ছে। পোশাকে, কথাবার্তায়— সবেতেই মেয়েরা অনেক আত্মবিশ্বাসী।’’
কথাবার্তা শুনে এ বার মুখ খুললেন শিক্ষিকার পাশে বসা সহযাত্রী। ‘‘বাজারের যা অবস্থা, তাতে দু’জনের রোজগার ছাড়া চলে না’’— বলছেন মিনতি সাধুখাঁ। শহরে আয়ার কাজ করেন তিনি। বছর দশেকের মধ্যে অর্থনৈতিক ছবিটা কি খুব বদলেছে? উত্তর এল, ‘‘আনাজের দাম জানেন? গ্যাসের দামও তো কী থেকে কী হয়ে গেল!’’ কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও তো একটা বড় বিষয়? নন্দিতাদেবী বলছেন, ‘‘সে তো বটেই। এই তো আমাদের সঙ্গে যায় শুভ্রা। স্বামী সরকারি চাকরি করেন। তা-ও নিজের বুটিক খুলেছে।’’
তবে কি আজও ট্রেনে চেনা মুখ দেখলে মনটা আনন্দে নেচে ওঠে ওঁদের? ইশারায় ডেকে পাশে বসান ট্রেনতুতো বন্ধুকে? মিনতিদেবী হেসে বললেন, ‘‘আমাদের একটা হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ আছে। কে কোন ট্রেনে উঠছি, ওখানে সব লিখে দিই। পিকনিকও হয়।’’ তবে নবীন প্রজন্মের মধ্যে যেন আলাপ করার তেমন ইচ্ছে নেই, জানাচ্ছেন নন্দিতাদেবী। তাঁর আক্ষেপ— ‘‘এখন সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। ছোট মেয়েগুলো কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে থাকে। নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে-আগ্রহ কোনওটাই যেন নেই।’’
মিনতিদেবীও মনে করছেন, ট্রেনালাপে ভাটা পড়ার অন্যতম কারণ সেই মোবাইল। জানালেন, আগে কামরায় পকেটমার উঠলে সকলে এককাট্টা হত। এখন কেউ ঝামেলায় জড়াতে চায় না। তবে মেয়েদের জন্য ট্রেন সফর যে এখনও নিরাপদ, তা নিয়ে একমত সকলেই। বরং রাত হয়ে গেলে বাসে করে ফিরতে এখনও বুক কাঁপে তাঁদের। অনেকে অ্যাপ-ক্যাব ভাড়া করেন। তবে তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
কথার মাঝে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন নন্দিতাদেবী। নামার আগে বলে গেলেন, ‘‘দশ বছরে কি কিছু বদলায়? যত দিন মেয়েদের জন্য মহিলা কামরা আছে, জানবেন কিচ্ছু বদলায়নি। এই যে শম্পা কানের দুল বিক্রি করেন, ওঁর কাছে নারী দিবস কী? স্রেফ আর একটা দিন, ব্যস।’’