প্রতীকী ছবি।
কোনও চক্রের কারবারিরা একেশ্বরবাদী। একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বরের ছায়ায় রয়েছেন। কোনও চক্রে গাদাগুচ্ছের স্থানীয় উপদেবতাদেরই পায়া ভারী। দেবরাজের দরবারে নৈবেদ্য পৌঁছতে বড্ড ধকল। ভোটের হাওয়ায় বেআইনি কয়লা, বালি, গরু থেকে খাদানের পাথর পাচার চক্রে এমন সব দেব-কাহিনি হাওয়ায় ভাসছে।
সাদা-বাংলায় এই দেবপ্রবর বা দেবকুলের একটা নামও এখন সর্বজনস্বীকৃত। প্রভাবশালী। ভোট-আবহে এই শব্দটাও ইদানীং কানে বড্ড জোরে বাজছে। “গ্রামবাংলায় শরৎচন্দ্র থেকে তারাশঙ্করের গল্পে চণ্ডীমণ্ডপের মোড়ল, মাতব্বরের আবর্তেও একটা প্রভাবের ছায়া ছিল, যা হয়তো আজকের বিচারে হালকা মনে হতে পারে”, হাসছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য। বাংলায় জমিদারির যুগের গোড়া থেকেই রয়েছে বেনামিতে জমি-কারবারের দুর্নীতি। এই সব কিছুর সঙ্গে প্রভাবের একটা যোগ ছিলই। প্রভাবের জোরে রাতকে দিন করা যায়। নির্দোষকে সহজেই ফাঁসিতে ঝোলানো সম্ভব। আবার প্রভাবের জোরেই খুন, ধর্ষণে অভিযুক্ত ধনীসন্তান বা শাসক দলের বিধায়কের কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না, এমন নমুনা এ দেশে এ যুগেও ভূরি ভূরি মিলবে।
প্রভাবের অদৃশ্য কিন্তু গভীর মহিমা প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা শম্পা চৌধুরী ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর ‘লঙ্কা-কাণ্ডে’ ডুব দিলেন।১৯৩৪এর ভূমিকম্পের পরের বিহার। জিরানিয়ায় সভা করে গানহীবাবা বলে ছিলেন, সবাই রিলিফ পাবে, দেশে রামরাজ্য হবে। কাংগ্রিসের মাস্টারসাহেব রিপোর্ট দিলেন। রিলিফও এল। কিন্তু কার অদৃশ্য কলকাঠিতে সব রিলিফ পেলেন পাকাবাড়ির বাসিন্দা বাবুসাহেবরা! প্রান্তিক মানুষের কপালে লবডঙ্কা। এমনকি সাঁওতাল পল্লির একমাত্র নলকূপের প্রাপ্তিযোগটুকুও বাবুসাহেবদের লাগোয়া বাগানের জন্য বলে বোঝা গেল।
সে-কালের বাবুসাহেবদের সঙ্গে গরু, বালি বা কয়লা করিডরের লভ্যাংশভোগীদের মিল খুঁজে পাওয়াটা আশ্চর্য নয়। প্রভাবশালীদের এমন গল্পও স্থানকালের আবর্তে বাঁধা পড়বে না। শেক্সপিয়রের রাজা লিয়র ‘পাগল-দশা’য় বুঝেছিলেন, গরিবের ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়ের ছ্যাঁদায় খুদে দোষত্রুটির দেখা মেলে, প্রভাবশালী মান্যগণ্যদের জোব্বা-গাউনে বিরাট অপরাধ ঢাকা থাকে।
জটিল যোগাযোগ, শীর্ষস্তরে নেটওয়ার্ক ছাড়া বড়সড় দুর্নীতি অসম্ভব! হর্ষদ মেটার শেয়ার কেলেঙ্কারি এখনও অনেকের স্মৃতিতে টাটকা। সৌরীনবাবুর মনে পড়ছে, “আমেরিকায় রেগনের আমলে মহাকাশ অভিযান সংক্রান্ত কিছু বরাত নিয়েও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তাঁর নেটিভ স্টেটের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে! অতএব এ দেশেও ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে অম্বানী-আদানিদের খাতিরদারির তত্ত্ব বিরল ঘটনা নয়।”
প্রভাবশালী শব্দটি তবু আমাদের প্রাত্যহিকতার লব্জে জোরালো ভাবে ঢুকে পড়ে সুপ্রিম কোর্টে সারদা কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত রায়ের সূত্রেই। সিবিআইয়ের সেই টাকা নয়ছয়ের সঙ্গে প্রভাবশালীদের যোগ তদন্ত করতে বলেছিল সর্বোচ্চ আদালত। হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এই প্রভাবশালীরা শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, বিনোদন জগত, ক্রীড়া জগত বা সংবাদমাধ্যমের কেউকেটাও ছিলেন বলে টের পাওয়া যাচ্ছিল। বেআইনি অস্ত্র কারবার থেকে মানুষ পাচার চক্র বা রাজ্যের বিভিন্ন পাচার-কারবারেও নানা নামজাদারা জড়িয়ে বলে অভিযোগ। পুলিশের নিচুতলা থেকে উপরমহলের কেউ কেউ প্রভাবশালীদের তালিকায় রয়েছেন।
আজকের বাংলার ভোট-রাজনীতি কিন্তু প্রভাবশালী শব্দটার ‘ভয়ঙ্কর বিস্তারও’ দেখছে, পর্যবেক্ষণ নাট্যকর্মী কৌশিক সেনের। তাঁর মতে, “রাজনীতির লব্জে ইচ্ছে করে তোলাবাজ, গরুচোর, কয়লাচোরদের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রের বুদ্ধিজীবী বা বিনোদন জগতের অপছন্দের মুখকেও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট পণ্ডিত বা জনপ্রিয় সেলিব্রিটিরও জনমানসে প্রভাব থাকে বলেই তাঁদের নিশানা করা হচ্ছে। রাজনীতির আক্রোশ মেটাতে অমর্ত্য সেনের মতো নোবেলজয়ী থেকে টলিউডের অভিনেত্রীও, তাই কদর্য আক্রমণের শিকার।”
প্রভাবশালী হওয়ার এমন খেসারতও এ যুগের সংস্কৃতি।