Independence Day Special

Independence Day 2022: কাকে স্বাধীনতা বলে, বুঝিনি

কয়েক মাস পরে এক প্রবল শীতের ভোররাতে আমি, দিদি আর ঠাকুরমা, জেঠতুতো দাদার সঙ্গে বেরিয়েছি ট্রেন ধরব বলে। আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

Advertisement

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২২ ০৬:১৯
Share:

কাশের বনে স্বাধীন শৈশব। মুর্শিদাবাদের লালবাগে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

ময়মনসিংহ। ১৯৪৭। ১৪ অগস্ট। আমার তখন এগারো বছর বয়স। ক’দিন যাবৎ মন খারাপ। দেশ স্বাধীন হচ্ছে, শুনছি, কিন্তু সেই সঙ্গে দেশটা হিন্দু-মুসলমানে ভাগও হয়ে যাচ্ছে! সেই আগাম খবর পেয়ে কয়েক মাস আগেই আমার রেলের চাকুরে বাবা অপশন দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছেন। অসমের আমিনগাঁওয়ে তাঁর পোস্টিং, সঙ্গে গিয়েছেন আমার মা, যাঁকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। আর সেই সঙ্গে আমার প্রবল ন্যাওটা দুটো ছোট ছোট ভাইবোন। আর তাই আমার মন ভাল নেই। মন ভাল নেই, কারণ আমি বুঝতে পারছি, এই প্রিয় মাতৃভূমি আর আমার থাকছে না, এক বিদেশ বা পরদেশ হয়ে যাচ্ছে। এই শহরেই আমার জন্ম, এর মাঠঘাটে দৌড়ঝাঁপ করে বড় হওয়া, ওই ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার, ওই মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে পড়া, ওই সব এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হাফ প্যাডলে সাইকেল চালানো— সব এক ঝটকায় মিথ্যে হয়ে গেল?

Advertisement

যদিও ময়মনসিংহ আমাদের দেশ নয়, আমরা ঢাকা বিক্রমপুরের লোক। তবু এই ময়মনসিংহেই দাদু আস্তানা গেড়েছিলেন। উঠোনের চার দিকে চারটে ঘর। তেমন আহামরি ঘরও নয়, টিনের চাল, মাটির ভিত। অনেক গাছপালা, দু’দুটো বড় বড় বাগান। আম, জাম, নারকেল, মর্তমান কলা, গন্ধরাজ লেবু, ঢেঁকিশাকের জঙ্গল, করমচাতলায় সন্ধেবেলা জোনাকির ঝাঁক, ব্রহ্মপুত্রের ওই পাড়ে অন্ধকার হলেই আলেয়ার আলোর জ্বলে জ্বলে ওঠা। এই সব মিলিয়ে-মিশিয়েই আমার দেশ, আমার প্রিয় মাতৃভূমি। তেমন কিছু নয়, কিন্তু অনেক কিছু। যে আরব মরুভূমির কাছে জন্মায়, সে-ও স্বদেশ বলতে বোঝে কিছু খেজুর গাছ, উট আর বালিয়াড়ি। তবু সেই স্বদেশের প্রতিও না তার কী গভীর টান!

মনে এক বিপুল ভার নিয়ে ঘুম থেকে উঠেছি। যে বাড়িটা লোকজনে গমগম করত, তা এখন হাঁ হাঁ করছে, ফাঁকা। আছি শুধু দিদি, ঠাকুরমা, এক জেঠতুতো দাদা আর আমি। দিদির আর আমার স্কুল চলছে বলে আমরা পড়ে আছি। আর সবাই কলকাতা বা আর কোথাও চলে গিয়েছেন। সকালের দিকেই দাদার বন্ধু ফজলুদা এসে হাজির। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বাড়িতে ফ্ল্যাগ তোলোস নাই ক্যান?’’

Advertisement

‘‘ফ্ল্যাগ! ফ্ল্যাগের কথা তো মনে নাই। বাড়িতেও ফ্ল্যাগ নাই।’’

একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘‘ফ্ল্যাগ আমি পাঠাইয়া দিতাছি। টাঙ্গাইয়া ফালা। না হইলে মাইনষে নানা রকম সন্দেহ করবো।’’

একটু পরে এক জন লোক এসে একটা সবুজ রঙের চাঁদ-তারা আঁকা ফ্ল্যাগ দিয়ে গেল। আমি সেটা সরু একটা বাঁশের ডগায় বেঁধে বারবাড়িতে পুবের ঘরের বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে উড়িয়ে দিলাম।

কাকে স্বাধীনতা বলে, তা সে দিনও যেমন বুঝিনি, আজও তেমনই বুঝি না। তবে একটু পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম স্বাধীনতা প্রাপ্তির মহোৎসবে। হাজারেবিজারে লোক বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়, প্রবল ধ্বনি উঠছে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। নতুন লুঙ্গি, নতুন জামা অনেকের পরনে, মুখে হাসি, চোখে দীপ্তি। রাস্তার ধারে সারি সারি গাইটঠা বোমা (মাটিতে লোহার নল পুঁতে ঠাসা বারুদ আর সলতে) ফাটছে। কানে তালা ধরিয়ে দেওয়ার জোগাড়। কিন্তু মন বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে, এ কিন্তু আর তোমার দেশ নয়। তোমাকে পাততাড়ি গুটোতে হবে। চলো মুসাফির, বাঁধো গাঁটরি। তাই সেই বিপুল উৎসবের আবহেও এক নিরানন্দ আমি পথে পথে হেঁটে শুধু এক বুক ক্লান্তি সঞ্চয় করে ফিরে এসেছিলাম। সে দিন আমার বন্ধুরাও কেউ কোথাও ছিল না। আমি সে দিন একদম একা।

কয়েক মাস পরে এক প্রবল শীতের ভোররাতে আমি, দিদি আর ঠাকুরমা, জেঠতুতো দাদার সঙ্গে বেরিয়েছি ট্রেন ধরব বলে। আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। চিরতরে। তখনও অন্ধকার। ভয়ঙ্কর শীতে হাত-পা কাল হয়ে যাচ্ছে। বারবাড়িতে পা রেখেছি সবে, এমন সময়ে আমারই পায়ের তলায় বোধহয় একটা লাল পিঁপড়ের বাসা ভাঙল, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ ও প্রতিশোধকামী হাজার হাজার পিঁপড়ে মুহূর্তে আমার দু’পা বেয়ে উঠে এসে আমাকে বিষজ্বালায় জর্জরিত করে দিয়েছিল। দু’হাতে চাপড়ে, কাচিয়েও সেই পিঁপড়েদের ছাড়াতে পারি না। চোখে জল এসে গেল যন্ত্রণায়। সেই বিষজ্বালা যেন এখনও টের পাই। হয়তো ওটাই ছিল আমার স্বদেশের পার্টিং কিক!

পঁচাত্তর বছর অনেকটা সময়। অনেক ঘাটের জল খেয়ে আজ এক জায়গায় নোঙর ফেলেছি। এ-ও কি আর আমার দেশ নয়! আর দেশটা তো সত্যিই পঁচাত্তর বছর আগে স্বাধীনও হয়েছিল। কোথাও খটকা থাকার কথা নয়। নেইও। তবু যেন আমার নিজেরই মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা, আমার চোখেই শুধু ধাঁধা, আমার পথেই শুধু বাধা! কেন যেন বোধ করি, স্বাধীনতা তাড়াতাড়ি এনে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য কিছু মানুষ বড্ড তড়িঘড়ি দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেই দেখেননি, তাতে লক্ষ লক্ষ লোককে সাত পুরুষের ভিটেমাটি, রুজি-রোজগার, আবেগ-ভালবাসা ছেড়ে, শিকড় উপড়ে এক অনিশ্চয়তায় পাড়ি দিতে হবে। সেই দুর্ভোগের ইতিবৃত্তান্ত ভুলে যাওয়ার মতোও তো নয়!

আর একটা কথা। স্বাধীনতার পরে ভারতবর্ষ কিন্তু যথেষ্ট উন্নতি করেছে। তবে ভারতের জনসংখ্যা যদি ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ে যা ছিল, ঠিক তা-ই থাকত, তা হলে আজ দেশটা ইউরোপের যে কোনও দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে নাসবন্দি চালু করার পরিণামে সরকারের পতন ঘটেছিল বলেই বোধহয় পরবর্তী কোনও সরকারই ভয়ে আর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সে ভাবে করেনি। অথচ, সাহসের সঙ্গে, কূটকৌশলে এই কাজটিরই কিন্তু সব চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়া দরকার। নইলে অর্থনীতি, জলবায়ু, শিক্ষা, পুষ্টি, দারিদ্র— কোনওটারই সুরাহা হবে না। ক্রমশ আরও বাড়বে দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার, হিংসা এবং সাম্প্রদায়িকতা। ভারতবর্ষের অভিশাপই হল তার অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা। সেটা দেশভক্তেরা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন, ততই মঙ্গল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement