দেশ স্বাধীন হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।
একটা বিরাট ছাদ ছিল আমাদের। আর চারপাশ ছিল একদম খোলা। রাস্তার নাম ছিল ‘কুইনস ওয়ে’, এখন যাকে মানুষ জনপথ রোড বলে জানে। আমরা রাতের বেলা ছাদে গিয়ে দাঁড়াতাম নানা রংয়ের আলোর খেলা দেখার জন্য। সফদরজং বিমানবন্দর থেকে নানা রংয়ের সার্চ লাইটের আলো আকাশে ফেলে বিভিন্ন ডিজ়াইন তৈরি করা হত।
কিন্তু সে দিনটা যে অন্য রকম ছিল, তা আমরা সকাল থেকেই জেনে গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন বছর আষ্টেক। বাড়ির বাইরে একা একা যাওয়ার চল ছিল না। তখনও আমরা স্কুলেও ভর্তি হইনি। আমার বাবা শ্রীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন স্বদেশি চেতনায় প্রাণিত সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিল্পী। পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী ছিলেন বাবার মামা। আমাদের ওই অল্প বয়সেই বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দের রচনা এনে দিতেন। পড়তে বলতেন, নিজে তো পড়তেনই। শেখাতেন রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান।
সেই দিনটা, অর্থাৎ সাতচল্লিশের ১৫ অগস্ট, সকাল থেকেই বাড়িতে উৎসবের পরিবেশ। বাবা রেডিয়োর পাশে বসে রয়েছেন। নানা রকম দেশাত্মবোধক গান হয়ে চলেছে। বাবা নিজেও হারমোনিয়াম টেনে গলা মেলাচ্ছেন। আমরা ভাইবোনেরা সব দল বেঁধে ছাদে উঠে পতাকা তুললাম, বড়দের তত্ত্বাবধানে। বুঝতে পারছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তার মর্ম যে ওই বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম তা নয়। বরং ওই আনন্দমুখর বাড়ির পরিবেশটাই আজও মনে আছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মাংস রান্নার গন্ধ।
সেই রাতে ছাদে গিয়ে খোলা আকাশের নীচে আমরা বাড়ির সবাই দাঁড়িয়েছিলাম। আর বিমানবন্দর থেকে আসা আলোয় গোটা আকাশ জুড়ে সে দিন শুধুই গেরুয়া, সাদা আর সবুজ, এই তিন রংয়ের খেলা! আজও সেই রাতের আকাশের কথা ভাবলে এই এত বয়সেও গায়ে কাঁটা দেয়। তখন বুঝিনি, তা ছিল স্বাধীন দেশের প্রথম রাতের আকাশ।
ফরিদপুর থেকে কলকাতা হয়ে আমরা দিল্লি এসেছিলাম স্বাধীনতার আগেই। কলকাতায় আমার ছবি আঁকিয়ে বাবা খুবই ঠকে যান মানুষের কাছে। রাতে সমস্ত বাস ডিপোতে ফিরলে তার পরে তার গায়ে বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকতেন। কিন্তু এত পরিশ্রম করেও যখন তাঁর বকেয়া পেতে কালঘাম ছুটে যেত, উনি দিল্লি চলে আসেন। তার পরে আমরাও। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে বাবা পায়ে হেঁটে আমাদের নিয়ে যেতেন ইন্ডিয়া গেট। সেখানে তখন ওই গেট ছাড়া তো আর কিছুই ছিল না। ধীরে ধীরে চোখের সামনে গড়ে উঠল আজকের দিল্লি। স্বাধীন ভারতের রাজধানী।
মায়া ভট্টাচার্য (প্রাক্তন শিক্ষিকা, শ্যামাপ্রসাদ স্কুল, দিল্লি)
অনুলিখন: অগ্নি রায়