Situation of the land in Singur

সিঙ্গুরে টাটাদের জন্য অধিগৃহীত সেই জমির একাংশে ফুটেছে কাশফুল, বাকিতে চাষ এবং ভেড়ি

আরও একটা বছর শেষ হতে চলল। একসময়ে টাটাদের জন্য অধিগৃহীত সিঙ্গুরের সেই জমির একাংশ (অন্তত ২৫০ একর) এখনও চাষযোগ্য হল না। অথচ, চেষ্টা কম হয়নি।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় 

সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২২ ০৬:৫৭
Share:

সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্প এলাকায় সিংহেরভেড়িতে এ বারও ফুটেছে কাশ। ছবি: দীপঙ্কর দে।

আগাছায় ঢাকা জমি এখনও সাফ হয়নি। ফসলও ফলেনি। এ বারও শরতে দেখা মিলেছে কাশের।

Advertisement

আরও একটা বছর শেষ হতে চলল। একসময়ে টাটাদের জন্য অধিগৃহীত সিঙ্গুরের সেই জমির একাংশ (অন্তত ২৫০ একর) এখনও চাষযোগ্য হল না। অথচ, চেষ্টা কম হয়নি। ফের একবার জমিকে চাষযোগ্য করে দেওয়ার দাবি তুলেছেন সেখানকার চাষিরা। টাটাদের তাঁরা তাড়াননি বলে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দাবি করেছেন, তাতে অবাক সেই চাষিদেরই একাংশ।

খাসেরভেড়ির রবীন পোলেন বলেন, ‘‘আমি টাটাদের কারখানার জন্য ৫২ বিঘে জমি দিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম সিঙ্গুরে কারখানা হোক। ছেলেরা চাকরি পাক। কিন্তু তৃণমূলের ভুল আন্দোলনের জন্যই তা হয়নি।’’ বেড়াবেড়ির বাসিন্দা অনন্ত বারুইয়ের গলাতেও ক্ষোভ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোটাই অসত্য। কারখানার জন্য ৪২ বিঘে জমি দিয়েছিলাম। জোর করে জমি নেওয়া হয়েছে? তিনি সেই তালিকা আগে প্রকাশ করুন। ওঁরা টাটাদের তাড়াননি? তা হলে সিঙ্গুর, শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়ায় টাটাদের প্রকল্পের কাজে যুক্ত যে অফিসারেরা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, তাঁদের কেন হুমকি দেওয়া হত? কারখানা উনিই করতে দেননি।’’

Advertisement

খাসেরভেড়ির সঞ্জয় দাস আবার অন্য কথা বলছেন। তিনি জমি দিতে রাজি হননি। কিন্তু তাঁর আড়াই বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি জমি ফেরত পেয়েছেন। চাষও করছেন। কিন্তু দেখছেন, তাঁর পরিচিত অনেকেই জমি চাষ করতে পারছেন না। কারণ, জমি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁদের তো সব দিকই গেল। ওঁদের কী হবে? সে উত্তর আজও মিলল না।’’ জয়দেব ঘোষ নামে গোপালনগরের এর ‘অনিচ্ছুক’ বলেন, ‘‘দোষারোপ অনেক শুনেছি। এ বার শিল্প হোক। জমি অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চাষ আর হবে না।’’

২০১৬-তে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে ভাঙা পড়ল কারখানা। তৈরি হল ধ্বংসস্তূপ। ফাইল চিত্র।

বাম আমলে টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্য ওই জমি অধিগৃহীত হয়েছিল। ২০১৬-তে সুপ্রিম কোর্ট অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে জমি চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। রাজ্যের তৃণমূল সরকার জমিকে চাষযোগ্য করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মাঠে নামে। সেই মতো কিছু কাজও হয়। চাষিরা জমিও ফিরে পান। কিন্তু তারপরেও অধিগৃহীত পাঁচ মৌজার প্রায় হাজার একর জমির মধ্যে অন্তত ২৫০ একর জমি এখনও চাষযোগ্য নয়। কোথাও আগাছা গজিয়েছে, কোথাও ঝোপঝাড়। সিংহেরভেড়িতে দেখা মিলেছে কাশের।

সংশ্লিষ্ট চাষিদের ক্ষোভ, বৃষ্টি হলেই ওই জমিতে জল দাঁড়িয়ে যায়। এ বারের বর্ষাতেও তাঁরা চাষ করতে পারেননি। তবে, চাষিদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পরে প্রকল্প এলাকার মধ্যে যে গোপালনগরে সর্ষেবীজ ছড়িয়ে চাষের সূচনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, সেই গোপালনগর-সহ অনেক জায়গাতেই চাষ হচ্ছে। কয়েকটি মেছোভেড়িও তৈরি হয়েছে। এতে তৃণমূলের দাবি, ভেড়িতে মাছ চাষ করে চাষিরা উপার্জন করতে পারবেন।

২০০৮-এ টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে গুজরাতের সানন্দে চলে যান। সেখানে তৈরি ন্যানো গাড়ি বাজার না-পেলেও টাটাদের অন্য গাড়ি তৈরি হচ্ছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে বহু মানুষের। এ সব খবরই পান সিঙ্গুরের চাষিরা। এখন তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, আন্দোলনের ফলে না হয়েছে শিল্প, না চাষ। চাষিরা জানান, ওই জমির বেহাল নিকাশিও একটা বড় সমস্যা। কারণ, টাটাদের প্রকল্প তৈরির সময় ওই জমিতে প্রাকৃতিক যে নিকাশি ব্যবস্থা ছিল, তা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। তার জেরে বর্ষার জল এখন ওই প্রকল্প এলাকা থেকে খাসেরভেড়ি এবং বাজেমিলিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। বাড়িঘর ডোবে। চাষিদের দাবিকে মান্যতা দিয়ে ওই জমিতে সমীক্ষার কাজ করে প্রশাসন। গত বছরের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার ওই জমির হাল দেখে গিয়েছিলেন। হুগলি জেলা সেচ এবং কৃষি দফতরের আধিকারিকেরাও যৌথ ভাবে পরিদর্শন করে ওই জমিকে যাতে ফের চাষযোগ্য করে তোলা যায় তার চেষ্টা শুরু করেন। মোট ছ’কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়। টেন্ডারের প্রক্রিয়াও হয়েছিল। প্রদীপ বলেন, ‘‘ওই প্রকল্প এলাকার একাংশের জমিতে চাষ এবং নিকাশির সমস্যা দূর করতে কাজ শুরু হয়েছিল। সেচ দফতরের অফিসারেরা সেই কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু মাঝে নির্বাচন এসে যায়। তার উপর কোভিডের প্রকোপ বাড়ে। তার ফলে পুরো বিষয়টিই বিলম্বিত হয়।’’

সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ তথা সিঙ্গুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ দুধকুমার ধাড়াও। তিনি বলেন, ‘‘চাষিরা চাইছেন ওই জমি অবিলম্বে চাষযোগ্য করে দেওয়া হোক। জমির নিকাশি ব্যবস্থা যথাযথ ভাবে ফিরিয়ে আনা হোক। আমরা দীর্ঘদিন আগেই ওই আবেদন করেছিলাম। প্রকল্প তৈরি করাও হয়। কিন্তু নানা কারণে কার্যকর করা হয়নি। আমরা চাইছি, অবিলম্বে প্রকল্প এলাকায় জমির বকেয়া কাজ শুরু করুক রাজ্য সরকার।’’ একইসঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। আমরা কারখানার বিরুদ্ধে ছিলাম না। জোর করে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। প্রকল্প এলাকার মধ্যে আমার ছয় বিঘা জমি ছিল। আমার জমি অথচ, কোনও মতামত দেওয়ার অধিকার ছিল না। আমরা যে ঠিক আন্দোলন করেছিলাম, সুপ্রিম কোর্টের রায়ই তার প্রমাণ।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement