অসহায়: মুর্শিদাবাদের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে সুতির আহিরণে নির্মীয়মাণ সেতুতে একাধিক গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
ফুলশহরীর পরে এ বার বহরমপুর!
এনআরসি ও নয়া নাগরিকত্ব আইনের ‘আতঙ্কে’ বহরমপুরের হাতিনগরে দু’জনের মৃত্যু হল বলে দাবি করল তাঁদের পরিবার। আজাহার শেখের (৬৯) পরিবারের দাবি, এনআরসি নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ছিলেন। প্রায়ই ভিটেবাড়ির দলিল ও কাগজপত্র খুঁজে বেড়াতেন। আজাহারের ছেলে মাজিল শেখ বলেন, ‘‘শনিবার দুপুরে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বাবা মারা যান। এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইনের আতঙ্কেই বাবার মৃত্যু হয়েছে।’’ আজাহারের পড়শি নুজুরা বিবির (৪৮) দেওর কামাল হোসেন বলছেন, ‘‘এনআরসি-র পর থেকেই ভাবি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
মাঝে মাঝে বলত, ‘এ বার বুঝি আমাদের দেশ ছাড়তে হবে।’ কাগজপত্র ঠিক করার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিল। ভয়েই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল ভাবি।’’
আরও পড়ুন: অবরোধে শামিল তৃণমূলও, আজ মিছিলে শুভেন্দু
এ দিকে, নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ-আন্দোলনের ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দেখেছিল মুর্শিদাবাদ। শুক্রবার থেকে সেই চেহারা বদলে যেতে শুরু করে। শনিবারেও সরকারি অফিস, স্টেশন ভাঙচুর, ট্রেন-বাস ও অন্য যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো নানা ঘটনায় আতঙ্কিত নবাবের জেলা। অভিযোগ, প্রকাশ্যে এমন হিংসাত্মক ঘটনা বেড়ে চললেও পুলিশ ও আরপিএফের দেখা মেলেনি। জঙ্গিপুরের ঘটনা প্রসঙ্গে এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘সর্বত্রই চেষ্টা করেছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশের সংখ্যা কম থাকায় বিক্ষোভকারীদের আটকানো যায়নি।’’ জেলার বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এমনটা চলতে থাকলে জেলায় আইন-শৃঙ্খলা একেবারেই ভেঙে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে শান্তির বার্তা দিচ্ছে ইমাম-মোয়াজ্জিন সংগঠন। সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দিন আবেদন করা হয়েছে, ‘‘নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে হিংসাত্মক নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করুন।’’ অল ইন্ডিয়া ইমাম-মোয়াজ্জিন অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের মুর্শিদাবাদের সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, ‘‘নয়া নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি-র বিরুদ্ধে আমরা সবাইকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি।’’
ওই সংগঠনের জেলা সভাপতি ওলিউল্লাহ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ইসলাম হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম শান্তির কথা বলে। তাই নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ যেন হিংসাত্মক না হয় তা আমরা জেলাবাসীকে বোঝাচ্ছি।’’
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শান্তির বার্তা দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েক মিনিটের ভিডিয়ো বার্তা জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেওয়া হচ্ছে। এ দিন বহরমপুরের সাংসদ কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা যেন কোনও সঙ্কীর্ণ রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে না ফেলি সেটা দেখবেন। রেল স্টেশন জ্বালিয়ে মানুষের যাতায়াতের সমস্যা তৈরি করা যেতে পারে, বাকি কিছু নয়। মুর্শিদাবাদ জেলা আমাদের সকলের গর্ব ও ভালবাসার জেলা। সাধারণ মানুষকে বলব, অকারণে উত্তেজনা তৈরি করবেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিদি আরও সক্রিয় হোন মুর্শিদাবাদ জেলা নিয়ে।’’ জেলা তৃণমূল সভাপতি আবু তাহের খানের আবেদন, ‘‘জেলাবাসীর কাছে অনুরোধ, আপনারা ধৈর্য ধরুন। মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, আমরা এ রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি চালু হতে দেব না। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি ভরসা রাখুন। আপনারা অশান্তিতে যাবেন না। আন্দোলন করতে হলে শান্তিপূর্ণ ভাবে করুন।’’ মুর্শিদাবাদ (দক্ষিণ) জেলা বিজেপির সভাপতি গৌরীশঙ্কর ঘোষও বলছেন, ‘‘মানুষের আন্দোলন করার অধিকার আছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই আন্দোলন করতেই পারেন। কিন্তু আন্দোলনের নামে এমন আচরণ কাম্য নয়।’’
মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মীনা বলেন, ‘‘জেলার রাজনৈতিক ও অন্য সব সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছি। তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।’’