—প্রতীকী ছবি।
ঠিক যেন ওটিটি-তে দেখানো থ্রিলার!
ভিন্ রাজ্যে কাজ চাই, কোথায় যোগাযোগ করব— পাহাড়ের দু’টি মেয়ে ঠিক এই ভাবেই সমাজমাধ্যমে ভাব পাতিয়েছিলেন সন্দেহভাজন পাচারকারীদের সঙ্গে। শুধুমাত্র একটি সূত্রের উপরে ভিত্তি করে। সেই সূত্রও তাঁদের দিয়েছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। একটি পাচারের অনুসন্ধানে নেমে সংস্থাটি পুলিশের সাহায্যে সন্দেহভাজনদের খুঁজে পায়। কিন্তু তাদের টোপ দেবে কে? এগিয়ে আসেন পাহাড়েরই দুই মহিলা।
ওই সংস্থা এবং পুলিশের সূত্র বলছে, এর পরে দু’মাস ধরে ওই দুই মেয়ে সন্দেহভাজন পাচারকারীদের সঙ্গে মেসেজে, ফোনে কথাবার্তা চালান। তাদের বোঝান যে, সত্যিই কাজের দরকার। সে জন্য অন্য যে কোনও রাজ্যে যেতে আগ্রহী তাঁরা। পাচারকারীরা নিশ্চিত হয়ে শেষমেশ মেয়েদের ডেকে পাঠায় শিলিগুড়িতে। ঠিক হয়, তাঁদের মুম্বইয়ের ট্রেনে তুলে দেবে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। পুলিশ সেখান থেকেই পাকড়াও করে চক্রের কয়েক জনকে। পুরস্কৃত করা হয় দার্জিলিং পাহাড়ের একটি চা বাগান এলাকার ওই দুই অসমসাহসী কন্যাকে।
কয়েক বছর আগের ঘটনা এটা। তখনও কিন্তু ওই চক্রের কয়েক জন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালায়। যদিও সেই সময় থেকেই স্টেশন, বাস টার্মিনাস এবং বিমানবন্দরে কড়াকড়ি বেড়ে যায়। পুলিশের দাবি, তার পর থেকে পাচারও অনেকটা কমে গিয়েছে।
যেমন দাবি মুর্শিদাবাদ বা দুই ২৪ পরগনাতেও। কিন্তু সত্যিই কি কমেছে পাচার? এনআইএ তদন্ত কিন্তু তা বলছে না।
সম্প্রতি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থাটি দেশ জুড়ে এই চক্রের ঘুঁটিগুলিকে পাকড়াও করতে অভিযান চালায়। এই রাজ্যেও উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়ায় তল্লাশি চালানো হয়। সঞ্জীব দেব, বিকাশ সরকার ও রাজু রুদ্র নামে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তে জানা গিয়েছে, আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা হলেও এ দেশে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব পরিচয়পত্র এবং নথিই পেয়েছিল তারা।
এনআইএ-র তদন্তকারী আধিকারিকদের দাবি, সেই সূত্রেই তাঁরা বিশেষ করে উত্তর ২৪ পরগনার বাম আমল থেকে বর্তমান শাসক দলের একাধিক জনপ্রতিনিধির ভূমিকা খতিয়ে দেখছেন। সূত্রের দাবি, বাংলাদেশ থেকে এ দেশে প্রবেশ করানোর পরে এই দেশের জন্মের শংসাপত্র থেকে শুরু করে ভোটার কার্ড এবং পাসপোর্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে ওই জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
কী ভাবে কাজ করে এই চক্রটি? গোয়েন্দারা জানান, বাংলাদেশ থেকে সেখানকার পাসপোর্ট নিয়েই ভারতে আসতেন লোকজন। তার পরে তাঁদের এ দেশের ভোটার, আধার, প্যান কার্ড এবং সর্বোপরি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিত চক্রটি। এর জন্য খরচ নেওয়া হত ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। অভিযোগ, এই চক্রের সঙ্গেই যুক্ত ছিল ধৃত তিন জন। আরও অভিযোগ, এই সব পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতেন কয়েক জন জনপ্রতিনিধি।
এক তদন্তকারী জানান, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ধৃতরা ওই কাজ করছে। চক্রের জাল অবশ্য দেশ জুড়ে ছড়িয়ে। এনআইএ জানিয়েছে, ওই চক্রের একাধিক সদস্য প্রথমে অসমে ধরা পড়ে। তাদের জেরা করেই বিকাশদের সন্ধান মেলে। গোয়েন্দাদের অনুমান, মানবপাচারই শুধু নয়, ওই চক্রের সাহায্যে ভারতে প্রবেশ করা বাংলাদেশিদের একটি অংশ নাশকতামূলক জঙ্গি কার্যকলাপেও যুক্ত থাকতে পারে। পুরোটা স্পষ্ট ভাবে জানতে চক্রের বাকিদেরও খুঁজে বার করতে হবে, জানাচ্ছেন এনআইএ আধিকারিকরাই।
পাচার যে হয়ে থাকে, তা মানছেন তৃণমূল বিধায়ক তথা চিত্র পরিচালক রাজ চক্রবর্তীও। তাঁর ‘আবার প্রলয়’ সুন্দরবন থেকে মেয়ে পাচার নিয়েই তৈরি। রাজ বলছেন, ‘‘বাস্তবের ঘটনা থেকেই আমি সিরিজটি তৈরি করেছি। পুলিশের কেস স্টাডি থেকে তথ্য নিয়ে তার পরে নিজেদের মতো করে সাজানো হয়েছে কাহিনি।’’
তবে রাজের কথায়, সরকারের প্রচেষ্টায় এখন পাচার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যায় এর পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে। এক, পুলিশ-প্রশাসনের কড়া নজরদারি। দুই, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প। তবে মুর্শিদাবাদের মতো জেলাতেই দেখা যাচ্ছে, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও পাচার বন্ধ করা যায়নি। কোনও ছুটির পরে স্কুল খুললেই দেখা যায়, আগের থেকে মেয়ের সংখ্যা কম। যদিও জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের দাবি, পাচার কমেছে। তাঁরা বলছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। ফলে মেয়ে হলেও তাকে লেখাপড়া শেখানোয় গুরুত্ব দিচ্ছেন বাবা-মায়েরা। এই ব্যাপারে মায়েদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, সামাজিক ভাবে সমস্যার মোকাবিলা শুরু হয়েছে।
এই যুক্তি দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সূর্যপ্রতাপ যাদব। একই কথা শোনা গিয়েছে রাজ চক্রবর্তী এবং জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার উমেশ খন্ডবহালের মুখেও। খন্ডবহালে তো এক কদম এগিয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা স্কুল-কলেজে শিবির করেন। ফলে জেলায় পাচারের প্রবণতা কমেছে।
যদিও সব ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান এ কথা বলছে না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন এমনও জানাচ্ছেন, উদ্ধার করে নিয়ে আসা মেয়েদের অনেকে ফিরে যাচ্ছেন সেই জীবনে। সমাজে তাঁদের একঘরে করে রাখা বা পুরনো জীবনে বেশি রোজগারের হাতছানি, এই কারণগুলিই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এঁদের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কিছু হাতের কাজ ছাড়া আর কী ব্যবস্থা করা গিয়েছে?
প্রলয়ের মেঘ তাই ঝড়ের সঙ্কেত নিয়ে রয়েই গিয়েছে আকাশে।
(শেষ)