অযত্ন: কচুরিপানায় ভরেছে সাঁতরাগাছি ঝিল। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
সাঁতরাগাছি পাখিরালয় রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার, সেই প্রশ্নেই কার্যত ‘অনাথ’ হয়ে গিয়েছে সাঁতরাগাছির ঝিল। যার জেরে অযত্ন আর অবহেলায় কয়েকশো একরের ঝিলটি হয়ে দাঁড়িয়েছে স্রেফ রেল ও এলাকার বাসিন্দাদের আবর্জনা ফেলার জায়গা। গোটা ঝিল ভরেছে প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতার কচুরিপানায়। গত বছর হাওড়া পুরসভা তা পরিষ্কার করলেও এ বছর কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। আবর্জনা আর কচুরিপানায় ভরা ওই ঝিলে এ বছর পরিযায়ী পাখিরা আগের মতো আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ, প্রতি বছরই দেখা যায়, হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেওয়া ওই পাখিরা কালীপুজোর পর থেকেই ঝিলে আসতে শুরু করে। সেই সংখ্যাটা কিন্তু এ বছর অনেক কম।
সাঁতরাগাছি ঝিল মূলত দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এলাকায়। ঝিল ও তার আশপাশের এলাকা অবশ্য হাওড়া পুরসভার ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। অভিযোগ, ওই ঝিলে পুর এলাকার সমস্ত বর্জ্য যেমন পড়ে, তেমনই সাঁতরাগাছি রেল ইয়ার্ডের একটা অংশের বর্জ্যও নর্দমা দিয়ে ঝিলের জলে পড়ে। ঝিলটিকে ঘিরে পাখিরালয় তৈরি হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল জেলা বন দফতরের। কিন্তু বছর তিনেক আগে জাতীয় পরিবেশ আদালত নির্দেশ দিয়ে জানায়, যে হেতু ওই ঝিলে পুরসভার বর্জ্য বেশি পড়ে, তাই প্রতি বছর কচুরিপানা পরিষ্কার এবং পাখিদের বসার জন্য ছোট ছোট পানার দ্বীপ তৈরি করার দায়িত্ব হাওড়া পুরসভারই। সেই নির্দেশের পরেই বন দফতর ঝিল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থেকে হাত তুলে নেয়।
এলাকার বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, পরিযায়ী পাখিদের পছন্দের জায়গা বা আদর্শ বাসস্থান সাঁতরাগাছির ঝিলটি দীর্ঘদিন ধরেই রেলের দূষিত বর্জ্য ও পুরসভার নর্দমার বর্জ্যে ভরে উঠেছে। জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশের পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। ঝিলটির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যখনই প্রশ্ন ওঠে, তখনই দূষণের ভাগীদার দুই সংস্থা একে অপরের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দেয়। যার ফলে পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম বড় আস্তানাটির রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে, প্রতি বছর তা নিয়েই নানা দফতরের মধ্যে চাপান-উতোর চলতে থাকে। আর অযত্নে, অবহেলায় পড়ে থাকে রাজ্যের এই দর্শনীয় পাখিরালয়টি।
ঝিলটির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ইতিমধ্যেই পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের করা মামলার প্রেক্ষিতে জাতীয় পরিবেশ আদালত রায় দিয়ে জানিয়েছে, ওই জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে পুরসভা ও রেলের খরচে একটি ‘সুয়্যারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ তৈরি করতে হবে। দু’টি সংস্থার সমস্ত বর্জ্য ওই প্লান্টে শোধন হওয়ার পরে তবেই ঝিলে ফেলা যাবে। জাতীয় পরিবেশ আদালতের সেই নির্দেশ এখনও পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। তাই দূষণও যে অব্যাহত, ওই ঝিলের চারপাশ ঘুরলেই তা দেখা যাবে। যত্রতত্র আবর্জনার পাহাড়। ঝিলের পাড়ে গড়ে উঠেছে বেআইনি হোটেল, মন্দির। এলাকার সমস্ত বর্জ্য অবাধে ফেলা হচ্ছে ঝিলের জলে। বিশাল ঝিলটির ১০ শতাংশ বাদে সবটাই ঢেকে রয়েছে কচুরিপানার জঙ্গলে।
এলাকার বাসিন্দা সুকান্ত পোদ্দার বলেন, ‘‘এখানকার বাসিন্দাদের বারবার বলেও কোনও লাভ হয়নি। রেল ও পুরসভা যদি সজাগ হত, তা হলেও এত বড় ক্ষতি হত না। প্রতি বছর এ সময়ে পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। এ বছর প্রায় আসেইনি।’’
ঝিলের কচুরিপানা পরিষ্কারের দায়িত্ব যাদের, তাদের বক্তব্য কী?
হাওড়া পুরসভার কমিশনার বিজিন কৃষ্ণ বলেন, ‘‘গত বছর ঝিল পরিষ্কার করতে গিয়ে আমরা সমস্ত কচুরিপানা তুলে ফেলায় সমস্যা হয়েছিল। কচুরিপানার ছোট ছোট দ্বীপ তৈরির করার জন্য আমাদের কোনও বিশেষজ্ঞ নেই। তাই এ বছর কেউ যদি আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসেন, আমরা তাঁকে লোকবল জোগান দেব। এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’’
হাওড়া জেলার মুখ্য বন আধিকারিক নিরঞ্জিতা মিত্র বলেন, ‘‘জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মেনে গত তিন বছর ধরে আমরা কচুরিপানা পরিষ্কার করছি না। আদালত হাওড়া পুরসভাকে নির্দেশ দিয়েছে। যা করার পুরসভাই করবে।’’