—ফাইল চিত্র।
জাল নথিপত্রের দৌলতে জলা বুজিয়ে প্লট হিসেবে বিক্রি করা, অন্যের জমি হাতিয়ে নেওয়া— হুগলিতে জমি-জালিয়াত চক্রের কাছে জলভাত! এমন নজির বিস্তর রয়েছে। কিন্তু এই উৎপাত রুখবে কে?
পুলিশ আছে। প্রশাসন আছে। কিন্তু ভূত রয়েছে সর্ষের মধ্যেই, দাবি ভূমি দফতরের কর্মীদের একাংশের। কেমন ভূত?
ওই কর্মীদের দাবি, সমস্যার কথা জানালে ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের একাংশের থেকে এই পরামর্শও মিলেছে— ‘দালাল-শ্রেণির সঙ্গে বিরোধ বুদ্ধিমানের কাজ নয়’। ভূমি দফতরে দালালদের মৌরসিপাট্টা ঠেকাতে মাস কযেক আগে জেলার একটি থানায় লিখিত আবেদন করা হয়। কিন্তু তাতেও দালালদের দাপট কমেনি বলে অভিযোগ।
কয়েক বছর আগে এক আইএএস অফিসার শ্রীরামপুর মহকুমায় ভূমি দফতরে ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙতে উদ্যোগী হন। তাতে তিনি সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের চক্ষুশূল হন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। বছর সাতেক আগে জেলা পুলিশের এক কর্তা জমি-জালিয়াতির ঘটনার বহর এবং তার সঙ্গে জড়িত চক্রের বিস্তার দেখে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, ‘‘এখান থেকে বদলি হতে চাইলে জমি সংক্রান্ত অভিযোগ আহ্বান করে টেবিল পেতে বসলেই যথেষ্ট।’’
সম্প্রতি এক ভূমি আধিকারিক সন্দেহ থাকায় একটি মিউটেশনের কাগজপত্র নিতে অস্বীকার করায় তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসার সংশ্লিষ্ট দালালের হয়েই সওয়াল করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই নিয়ে ওই দফতরের অফিসারদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রীতিমতো বিতর্কও হয়।
জেলার একটি ভূমি দফতরের এক রাজস্ব-আধিকারিকের খেদ, ‘‘আমরা দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করি। তাতে গালিগালাজ হজম করতে হয়। হুমকিও দেওয়া হয়।’’ তাঁর সংযোজন, ভূমি দফতরে সাধারণ মানুষ সরাসরি পরিষেবা পেতে পারেন। কিন্তু মুহুরির বেশে দালালদের উপস্থিতি নিয়ম হয়ে গিয়েছে। কিছু বললে দালালরা সটান জানিয়ে দেয়, সরকারি অফিসে যে কেউ আসতে পারেন।
ভূমি দফতরের কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, জমি-জালিয়াত চক্রে অসাধু জমি-কারবারিদের লোকলস্কর বা দালালের পাশাপাশি এক শ্রেণির মুহুরি, আইনজীবী, সরকারি কর্মী, জনপ্রতিনিধি এমনকী দুষ্কৃতী-যোগ পর্যন্ত থাকে। সরকারি দফতরের নথিতে চক্রের কেউ জমির মালিক বনে যায়। তাকে জমি-মালিক হিসেবে শনাক্ত করে অন্য কেউ। মেমো নম্বর, সিল, তারিখ ছাড়াই জনপ্রতিনিধির দেওয়া উত্তরাধিকার শংসাপত্র জমা পড়ে। এ সবের ভিত্তিতেই ‘কাজ’ হাসিল হয়ে যায়। ছ’মাসের ব্যবধানে একই জনপ্রতিনিধির দেওয়া শংসাপত্রে উত্তরাধিকারীর নাম বদলে যাওয়ার নজিরও রয়েছে।
আরও অভিযোগ, দালালদের হাত অনেক লম্বা। তারা ভূমি দফতরে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে। কোনও আধিকারিক ভুয়ো নথি জমা নিতে অস্বীকার করলে বা কাগজপত্রে কারও নাম নিয়ে সন্দেহের জেরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শুনানিতে ডাকলে দালালরা
খেপে ওঠে।
এক ভূমি আধিকারিকের কথায়, ‘‘সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, এমন নথি জমা নিতে না-চাইলে দালালরা হইচই শুরু করে। সাধারণ মানুষের মিউটেশনের আবেদনপত্রে দালাল নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দেন। ফলে, আবেদনকারীর মিউটেশন সংক্রান্ত যাবতীয় খবর দালালের কাছেও চলে যায়। আবার এই সব অনৈতিক কাজে বাধা পেলে এরাই দফতরে কাজ হচ্ছে না বলে পোস্টার সাঁটে।’’
জেলার এক ভূমি-কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘অনিয়ম বা দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ পেলে আইন মোতাবেক পদক্ষেপ করা হয়।’’ জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাওয়ের আশ্বাস, ‘‘নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কিন্তু তাতে কি ভূমি দফতরের সব অফিসের দালাল-রাজ বন্ধ হবে? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। (শেষ)