শোকার্ত: কান্নার রোল পরিজনদের। ছবি: তাপস ঘোষ
কুড়ি মাস ধরে বন্ধ চন্দননগরের গোন্দলপাড়া জুটমিল। ফলে, আর্থিক সঙ্কটের মুখে এখানকার শ্রমিক মহল্লা। অভিযোগ, মিল বন্ধের জেরে অনটনের কারণে বেশ কয়েকজন শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। দুশ্চিন্তায় ভুগে অনেকেই রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। মিলছে না উপযুক্ত চিকিৎসা। তার জেরেও একের পর এক মৃত্যু ঘটছে। সেই তালিকায় সংযোজিত হল আরও এক জনের নাম। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে বুধবার রাতে মৃত্যু হল তেজনারায়ণ যাদব (৩৬) নামে ওই শ্রমিকের।
পরিবারের লোকেরা জানান, ওই যুবক গোন্দলপাড়া জুটমিলের তাঁত বিভাগের অস্থায়ী শ্রমিক ছিলেন। বুধবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তাঁকে চন্দননগর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত ১১টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। চিকিৎসকেরা জানান, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গিয়েছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। ঠিক আগের দিন, মঙ্গলবার ভরত চৌধুরী নামে বছর পঞ্চাশের এক শ্রমিকও মারা যান হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে। একের পর এক শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন।
২০০৫ সালে এই জুটমিলে যোগ দেন তেজনারায়ণ। তাঁর তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে আরিয়ানের বয়স ৬ বছর। কনিষ্ঠ আময়বার বয়স পাঁচ মাস। এই পরিস্থিতিতে স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী আশা। শ্রমিক মহল্লায় টালির চালের একফালি ঘরের দাওয়ায় মেয়ে আময়বাকে কোলে নিয়ে তিনি জানালেন, মিল বন্ধের পর থেকে ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন তেজনারায়ণ। কিন্তু সব সময় কাজ জুটছিল না। ফলে, সংসার চালাতে সমস্যা হচ্ছিল। সেই কারণে সব সময় দুশ্চিন্তা করতেন। আশার খেদ, ‘‘দুশ্চিন্তাতেই স্বামীর প্রাণটা এই ভাবে চলে গেল। এখন পাঁচ সন্তানকে কী করে মানুষ করব? কে ওদের দুধ কিনে আনবে? মিলের দরজা খুলে দিলে এই পরিস্থিতি হত না।’’
তেজনারায়ণের দুই দাদাও ওই জুটমিলের শ্রমিক। মিল বন্ধের জেরে তাঁদেরও রোজগার তলানিতে। দাদা সুকর যাদব বলেন, ‘‘স্থায়ী রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করা নিয়ে ভাই খুব চিন্তায় পড়েছিল। তাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হয়তো আগেই অসুস্থ ছিল। চিকিৎসায় খরচের কথা ভেবে কাউকে কিছু জানায়নি। আর কত মৃত্যু দেখতে হবে আমাদের!’’ স্থানীয় বাসিন্দা তথা ওই চটকলের শ্রমিক রঞ্জিত সাউ বলেন, ‘‘এলাকায় যেন মড়ক লেগেছে।’’
শ্রমিকরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে মিল বন্ধ থাকায় ইএসআই হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসার সুযোগ মিলছে না। বুধবার চন্দননগরের নাগরিক সমাজের তরফে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করা হয়। নিখরচায় ওষুধও দেওয়া হয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, মিল বন্ধের পর থেকে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মিল না খুললে এই সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। যতদিন না মিল খুলছে, ততদিন এখানকার শ্রমিক পরিবারের চাল-ডাল, চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থার ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার, এই দাবি উঠছে।